লেখকের বক্তব্য: এই লেখাটির সর্বস্বত্ব-সংরক্ষিত (কপিরাইটেড) এবং ‘বিবেকভারতী’ ব্লগে প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে রচিত। এই লেখাটি লেখকের বিনা অনুমতিতে অন্যত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ। এর বাণিজ্যিক ব্যবহার সকল অবস্থাতেই নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র হিন্দুধর্ম ও আমাদের প্রিয় ভারতীয় সংস্কৃতির যথাযথ প্রচারার্থে বিনামূল্যে বিতরণের জন্যই এটি অন্যত্র প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হবে। কারণ, এই নিবন্ধের মূল সুরটিই হল হিন্দুধর্ম ও ভারতের কল্যাণ।
১
ভূমিকা
আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য প্রধান ধর্মগুলির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব প্রতিটি ধর্মই কোনো না কোনো একক ধর্মপ্রচারকের দ্বারা প্রবর্তিত। গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন ; যিশু খ্রিস্ট খ্রিস্টধর্ম এবং হজরত মহম্মদ ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেন। কিন্তু আমাদের হিন্দুধর্ম কোনো এক জন মাত্র ব্যক্তির দ্বারা প্রবর্তিত হয়নি। এটি আমাদের ধর্মের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কোনো এক জন মানুষের জীবনকথা হিন্দুধর্মের ভিত্তি নয়। তাহলে আমাদের হিন্দুধর্মের ভিত্তিটি কী ; এর প্রামাণিকতাই বা কোথায়? হিন্দুধর্মের ভিত্তি হল সেই পরম সত্য ; যাঁকে ঈশ্বর নামে সকল ধর্মে পূজা করা হয়। ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিদের ঈশ্বরদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই হিন্দুধর্মের প্রামাণিকতা। আমরা সাধারণ মানুষেরা ঈশ্বর সম্পর্কে যা অনুভব করি, তা অসম্পূর্ণ। একমাত্র মহান ঋষিদের কাছেই ঈশ্বরের মহান সত্যটি প্রকাশিত হয়। প্রাচীন কালের ঋষিগণ তাঁদের এই ঈশ্বরানুভূতির কথা ধরে রেখেছিলেন ‘শ্রুতি’ নামে এক শ্রেণির শাস্ত্রে।
২
বৈদিক সাহিত্য
বেদ
শ্রুতি কী? ‘শ্রুতি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘যা শোনা হয়েছে’। সুপ্রাচীন কালের বৈদিক ঋষিরা কঠোর তপস্যা করে নিজেদের শুদ্ধ করেন। তখন তাঁরা তাঁদের হৃদয়ে স্বয়ং ঈশ্বরের বাণী শুনতে পান। ঈশ্বরের মুখ থেকে শোনা এই সত্যগুলি তাঁরা যে পবিত্র গ্রন্থরাজিতে ধরে রাখেন, তারই নাম হল ‘শ্রুতি’। শ্রুতি মানুষের লেখা বই নয় ; তাই শ্রুতিকে বলা হয় ‘অপৌরুষেয়’। শ্রুতিকেই আমরা সাধারণত চিনি ‘বেদ’ নামে। ‘বেদ’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’। এই প্রসঙ্গে স্বামী নির্মলানন্দ লিখেছেন, “হিন্দুদের কয়েকখানি বিশেষ ধর্মগ্রন্থকে কেন বেদ বলে তাহার একটি কারণ আছে। সংস্কৃতে ‘বিদ্’ ধাতুর অর্থ ‘জানা’। এই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন বলিয়া ‘বেদ’ শব্দের মূল অর্থ ‘জ্ঞান’। বেদ বলিতে বিশেষতঃ ঈশ্বর, জীব ও জগৎ সম্বন্ধে পারমার্থিক জ্ঞানই বুঝায়। সৃষ্টিও যেমন অনাদি ও অনন্ত, ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানও তেমনই অনাদি অনন্ত। ঈশ্বর সম্বন্ধে এই শাশ্বত ও অফুরন্ত জ্ঞানরাশিই বেদ শব্দের মুখ্য অর্থ। এই অপরিসীম জ্ঞানরাশির কিছু অংশের সন্ধান হিন্দু তত্ত্বদ্রষ্টাগণ পাইয়াছিলেন। তাহাই লিপিবদ্ধ হইয়া বেদ নামে প্রচলিত হইয়াছে।” বেদের আরও দুটি নাম হল ‘আগম’ ও ‘নিগম’। ‘আগম’ শব্দের অর্থ ‘যা ঐতিহ্য রূপে আমাদের কাছে এসেছে’ এবং ‘নিগম’ শব্দের অর্থ হল ‘যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘আগম’ ও ‘নিগম’ তন্ত্রশাস্ত্রের দুটি বিভাগেরও নাম ; সেগুলি সম্পর্কে পরে যথাস্থানে আলোচনা করা হবে।
দেবনাগরী হরফে লেখা ঋগ্বেদের পুথি, উনিশ শতক
বেদ চারটি। যথা–(১) ঋগ্বেদ, (২) সামবেদ, (৩) যজুর্বেদ ও (৪) অথর্ববেদ। এগুলির মধ্যে ঋগ্বেদ সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে বড়ো। ঋগ্বেদ প্রধানত ‘ঋক’ বা প্রার্থনা মন্ত্রের সংকলন। হিন্দুধর্মের বিখ্যাত গায়ত্রী মন্ত্র ঋগ্বেদ-এরই অংশ। সামবেদ-এ ঋগ্বেদ-এর বাছাই করা কয়েকটি সূক্তে সুরারোপ করে কয়েকটি যজ্ঞের বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে সেগুলি গান করার নির্দেশ দেওয়া আছে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদি উৎস হল এই সামবেদ। যজুর্বেদ-এ রয়েছে মূলত যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। অথর্ববেদ অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা। এই বেদে রয়েছে নীতিতত্ত্ব ও আয়ুর্বেদ ইত্যাদি কয়েকটি বিজ্ঞানের বর্ণনা।
এই চারটি বেদের প্রতিটি আবার চারটি করে অংশে বিভক্ত। এগুলি হল–(১) সংহিতা বা মন্ত্রভাগ, (২) ব্রাহ্মণ, (৩) আরণ্যক ও (৪) উপনিষদ্। ‘সংহিতা’ অংশে লিপিবদ্ধ হয়েছে ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, বিষ্ণু, রুদ্র প্রমুখ বৈদিক দেবতার বিভিন্ন মন্ত্র ও স্তবস্তুতি। ‘ব্রাহ্মণ’ অংশে রয়েছে মন্ত্রের ব্যাখ্যা ও যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। কোন যজ্ঞে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা দরকার, তা জানা যায় ব্রাহ্মণ অংশ থেকে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে, ব্রাহ্মণ জাতির সঙ্গে এই গ্রন্থের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘আরণ্যক’ অংশে রয়েছে বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা। ‘উপনিষদ্’ অংশটিতে পরম সত্যের এক মরমিয়া ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরম সত্যকে উপলব্ধি করার শ্রেষ্ঠ পন্থাটিও উপনিষদ্ই আমাদের শিক্ষা দেয়। স্বামী হর্ষানন্দের ভাষায়, “উপনিষদ্গুলি হলো দার্শনিক নিবন্ধ। এদের উপজীব্য ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালবর্তী সত্যবস্তু’, ‘মানুষের প্রকৃত স্বরূপ’, ‘জীবনের উদ্দেশ্য ও সেই উদ্দেশ্যসাধনের উপায়’ প্রভ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন