বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬

আত্মা কি?

ভারতীয় সভ্যতার অতীত দুটি ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ভবিষ্যতও দুটি ধারণার পুনর্ব্যাখ্যা ও পুনরুৎপাদনের উপর নির্ভর করবে। তা হলো, আত্মা ও ব্রহ্ম। ভারতীয় দর্শন ও ভাবজগতের মূল শেকড় এ দুটি ধারণার ভেতর প্রোথিত। বহুমাত্রিক উৎকর্ষের বাস্তবিক ঐক্যের প্রতীক ভারতীয় সভ্যতা। সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনে রাজা যায় রাজা আসে। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের সৌধ, আত্মিক আকাঙ্ক্ষার মিনার উচ্চ থেকে উচ্চতর গগণ চুমেছে।

অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ভারতীয় চিন্তার বিশয়-আশয় তেমন পরিবর্তিত হয়নি। যদিও ষড় দার্শনিক শ্রেণী, ধর্মগুরু ও ভাবুক-ঋষীদের স্থানিক ও কালিক ব্যাখ্যা নিয়ে ইহজগৎ ও পরজগতের ভেদ-অভেদ সম্পর্কে নতুন নতুন বয়ান তৈরি হয়েছে। তবু অসম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতিজগত ও চিন্তা বলয়ে আধ্যাত্মিক ও বস্তুজগতের প্রমিত এবং মীমাংসিত কোনো ব্যাখ্যা নাই।

মীমাংসিত দর্শনের অভাব আমাদের মূর্খ ‘ভাবের’ স্বভাব কিনা এই সন্দেহের অবতারণা করেই বলা যায়, চরম ভোগবাদী ও বস্তুবাদী আধুনিক প্রজন্মের জীবন জিজ্ঞাসা পরিশেষে এই দুই মূলের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে। কারণ চরম ভোগবাদিতা ও বস্তুবাদী মানসিকতা থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং হতাশা জন্ম নেয়। এছাড়া বস্তুর শেষ সীমা হলো অবস্তু। এমনকি বস্তুর গভীরতর অন্বেষা অবস্তুর ইঙ্গিত দেয়।

বর্তমান পদার্থ বিজ্ঞানেরও মূলকথা এই যে, পদার্থ মানে শুধু বস্তু নয়, অবস্তুগত চেতনা, শক্তি এবং বস্তুর ধর্মও পদার্থের মৌলিক অংশ। এ কারণেই বস্তুর সামগ্রিক অনুধাবন সরল বস্তুবাদের অসারতা এবং ভোগবাদীতার সমাপ্তির কথা জানান দেয়।

মানুষের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ কিছু মৌলিক দার্শনিক অবস্থান থেকে উৎসারিত হয়। তাই যুগ যুগান্তরের পরম্পরায় ভারতীয় মানুষের জীবনাচার, জীবন-জগতের মূল্যায়ন, পুরো মহাজগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিচারসহ জীবন সম্পৃক্ত হাজারো প্রশ্ন দার্শনিক বাহাস আকারে পুনঃমূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে। ভারতীয় সভ্যতার ধর্মভাব, নীতি-মূল্যবোধের মূল ভিত্তি হল দর্শন।

দর্শনের আওতায় ধর্মভাব অথবা ধর্মীয় পদ-পদার্থের দার্শনিক ভেদ বিচার পুরাতন রেওয়াজেরই নতুন আবৃত্তি। এক্ষেত্রে আত্মা ও ব্রহ্ম সম্পর্কিত প্রচলিত মত-মতান্তরের প্রতি অঞ্জলি দিয়ে সমকালীন ভাবধারা সনাক্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছি।

এক সময় বিশাল প্রকৃতি জগতে মানুষ নিজেকে নিঃসঙ্গ ও অসহায় পেয়ে আধ্যাত্মিক অন্বেষায় প্রবৃত্ত হয়েছে। আধুনিক যুগেও অজস্র ভিড়ের মাঝে প্রত্যেকে নিঃসঙ্গ এবং কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এই আধুনিক নিঃসঙ্গ বিমুঢ়তা থেকে মুক্তির পথও এই ভোগে নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। এ আওয়াজ আসতে শুরু করেছে। কারণ সমাজে এখন এক ধরণের আধ্যাত্মিক অশান্তি বিরাজ করছে। আর আধ্যাত্মিক অশান্তি থেকেই দর্শনের উৎপত্তি ঘটে।

আধ্যাত্মিক অশান্তি মানে অসন্তুষ্টি। মানুষ বস্তুগত চটুল জ্ঞানের পরিধি পেরিয়ে যখন অবস্তুগত চেতনার দিকে অনুসন্ধিৎসু মনকে প্রবিষ্ট করে তখন চেতনা ছাড়া আর কিছুই পায় না। কিন্তু চেতনা ভাষাহীন বা ভাষাতীত। এই ভাষাতীত জিনিসকে আয়ত্ত্ব করতে চাই যৌক্তিক কাঠামো ও সূত্রায়ন, যা বোধগম্য ভাষায় রূপান্তরযোগ্য। এই ভাষাতীত চেতনাকে যৌক্তিক ভাষায় সূত্রবদ্ধ করলে যা দাঁড়ায় তা হল দর্শন। আর এই ভাষিক সূত্রকে অণু-পরমাণু কিংবা বস্তুর কাঠামোতে স্থাপনযোগ্য করে বস্তুগত উৎপাদনের আওতায় আনতে পারলে যা হয় তার নাম বিজ্ঞান। মূর্ত জীবন ভাবনার বিমূর্ত স্তর হল দর্শন আর বিমূর্ত ভাবের মূর্ত অবয়ব হল বিজ্ঞান ও বাস্তবতা। তাই সাধারণ মানুষের সরল জীবন ভাবনার বিভ্রান্তিকে বিশুদ্ধ করতে দর্শন আর দেশ-কালের দাহনে অতৃপ্ত জীবন বোধে তৃপ্তি আনতে আধ্যাত্মিকতার কাছেই মানুষ বার বার প্রত্যাবর্তন করে।

যদিও ভারতীয়দের বিশ্বাস কোনো মানুষ বেদ রচনা করেনি, বেদ স্বয়ং ব্রহ্মের বাণী। ধারণা করা হয়ে থাকে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বে বেদ রচিত হয়েছিল। পরে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে উপনিষদ রচিত হয় যেখানে প্রথম বেদের দার্শনিক সংশ্লেষ পাওয়া যায়। বেদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে এমন দার্শনিক ঘরানাকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে যারা আস্তিক বলে বিবেচিত এবং ছয়টি দার্শনিক ঘারানা ষড় দর্শন হিসেবে পরিচিত। এই আস্তিক ষড় দর্শন হল- সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শন। শাস্ত্র হিসেবে বেদের প্রাধান্য স্বীকার করে না এ রকম নাস্তিক ঘারানার দর্শন হল- চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন।

জড়বাদী চার্বাক দার্শনিকদের মতে দেহাতিরিক্ত অজড় কোনো আত্মা নাই। চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে কোনো অবস্তুগত চেতন আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। তাই আত্মাও নাই। কিন্তু জৈনরা বেদের শাস্ত্রিক প্রাধান্য স্বীকার না করলেও পুরোপুরি বস্তুবাদী নয়। তারা একটি দেহাতিরিক্ত সত্ত্বা হিসেবে আত্মার অস্থিত্ব স্বীকার করে। তাদের মতে আত্মা সচেতন, সগুণ, নিত্য ও সক্রিয় দ্রব্য। দ্রব্

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন