শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

*আসল কৃষ্ণ*


মূল রচনা - কৃষ্ণচরিত্র -দ্বিতীয় খণ্ড /দশম পরিচ্ছেদ, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 

মূল রচনার ভাবার্থ কে অপরিবর্তিত রেখে, উক্ত পোস্টে আরো নতুন কিছু তথ্য যোগ করে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে মাত্র, যাতে পাঠকরা অল্প সময়ে রচনাটি পড়তে পারে ও শ্রীরাধার সম্পর্কে আরো স্পস্ট ভাবে বিশ্লেষণটিকে বুঝতে পারে।

সম্পাদক- সমীর কুমার মন্ডল 

উপযুক্ত প্রমাণে এটাই প্রমাণিত হয় শ্রী কৃষ্ণের জীবনী তে শ্রী রাধা নামে কোনো নারীর সাথে সম্পর্ক ছিল না। মামির সম্পর্ক তো দূরে থাক, রাধা নামে কোনো গোপী শ্রী কৃষ্ণের সমগ্র জীবনী তে ছিলো না। এই রাধা উৎপত্তি এবং তার সাথে মামির সম্পর্ক ও অবৈধ্য সম্পর্ক সৃষ্টিকার হলেন পূর্বের কিছু “রসময় সাহিত্যিক চরিত্রের বৈষ্ণব মানুষ ও তাদের তৈরী কিছু কাব্য”।

নিচের অংশ গুলি- বঙ্কিমচন্দ্রের “শ্রী কৃষ্ণচরিত্র” গ্রন্থের লেখকের ভাবদৃষ্টি অনুসারে শ্রী রাধা ব্যাখ্য সংগ্রহ করে তুলে ধরা হল.

ভাগবতের এই “রাসপঞ্চাধ্যয়ের” মধ্যে ‘রাধা’ নাম কোথাও পাওয়া যায় না।কিন্তু বৈষ্ণবদের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট। তাঁহারা টীকাটিপ্পনীর ভিতর পুনঃ পুনঃ রাধাপ্রসঙ্গ উত্থাপিত করেছেন, কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নাই। গোপীদিগের অনুরাগাধিক্যজনিত ঈর্ষার প্রমাণ স্বরূপ কবি লিখিয়াছেন যে,তাহারা পদচিহ্ন দেখিয়া অনুমান করিয়াছিল যে, কোন একজন গোপীকে লইয়া কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাও গোপীদিগের ঈর্ষাজনিত ভ্রমমাত্র। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলেন এই কথাই আছে, কাহাকেও লইয়া অন্তর্হিত হইলেন, এমন কথা নাই এবং রাধার নামগন্ধও নাই।

“রাসপঞ্চাধ্যায়ে” কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নাই। ভাগবতে কেন,বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশে বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নাই। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণনাম নাই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নাই বা মূর্তি নাই। বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্যলাভ করিয়াছেন যদিও মহাভারতে, হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে বা ভাগবতে ‘রাধা’ নাই। উপনিষদ সকলের মধ্যে একখানির নাম গোপালতাপনী।কৃষ্ণের গোপমূর্তির উপাসনা ইহার বিষয়। উহার রচনা দেখিয়া বোধ হয় যে,অধিকাংশ উপনিষদ্ অপেক্ষা উহা অনেক আধুনিক ও নবীন। ইহাতে কৃষ্ণ যে গোপগোপীপরিবৃত তাহা বলা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে গোপগোপীর যে অর্থ করা হইয়াছে, তাহা প্রচলিত অর্থ হইতে ভিন্ন। গোপী অর্থে “অবিদ্যা কলা”। টীকাকার বলেন,- “গোপায়ন্তীতি গোপ্যঃ পালনশক্তয়ঃ।” আর গোপীজনবল্লভ অর্থে“গোপীনাং পালনশক্তীনাং জনঃ সমূহঃ তদ্বাচ্যা অবিদ্যাঃ কলাশ্চ তাসাং বল্লভঃ স্বামী প্রেরক ঈশ্বরঃ।” উপনিষদে এইরূপ গোপীর অর্থ আছে। কিন্তু রাসলীলার কোন কথাই এখনে নাই। রাধার নামমাত্র নাই। এক জন প্রধানা গোপীর কথা কাছে, কিন্তু তিনি রাধা নহেন, তাঁহার নাম গান্ধর্বী। তবে এ ‘রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে?

  রাধাকে প্রথমে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেখিতে পাই। উইল্‌সন্ সাহেবর মতে ইহা পুরাণগণের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলিয়াই বোধ হয়। ইহার রচনাপ্রণালী আজিকালিকার ভট্টাচার্যদিগের রচনার মত। ইহাতে ষষ্ঠী মনসারও কথা আছে। আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বিলোপপ্রাপ্ত হইয়াছে। যাহা এখন আছে, তাহাতে এক নূতন দেবতত্ত্ব সংস্থাপিত হইয়াছে। পূর্বাবধিতে প্রসিদ্ধ যে, কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার কিন্তু এখানে পুরানকার বলেন, কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার হওয়া দূরে থাকুক, কৃষ্ণই বিষ্ণুকে সৃষ্টি করিয়াছেন। বিষ্ণু থাকেন বৈকুণ্ঠে, কৃষ্ণ থাকেন গোলোকে রাসমণ্ডলে,—বৈকুণ্ঠ তাহার অনেক নীচে। ইনি কেবল বিষ্ণুকে নহে, ব্রহ্মা, রুদ্র,লক্ষ্মী, দুর্গা প্রভৃতি সমস্ত দেবদেবী এবং জীবগণকে সৃষ্টি করিয়াছেন। ইঁহার বাসস্থান গোলকধামে, বলিয়াছি। তথায় গো, গোপ ও গোপীগণ বাস করে। তাহারা দেবদেবীর উপর। যে গুলি সবটায় মিথ্যা ছাড়া আর কিছু না। সেই গোলোকধামের অধিষ্ঠাত্রী কৃষ্ণবিলাসিনী দেবীই রাধা। রাধার আগে রাসমণ্ডল,রাসমণ্ডলে ইনি রাধাকে সৃষ্টি করেন। রাসের রা, এবং ধাতুর ধা, ইহাতে রাধা নাম নিষ্পন্ন করিয়াছেন। সেই গোপগোপীর বাসস্থান রাধাধিষ্ঠিত গোলোকধাম পূর্বক বিদিগের বর্ণিত বৃন্দাবনের বজনিশ নকল। এখনকার কৃষ্ণযাত্রায় যেমন চন্দ্রাবলী নামে রাধার প্রতিযোগিনী গোপী আছে, গোলকধামেও সেইরূপ বিরজা নাম্নী রাধার প্রতিযোগিনী গোপী ছিল। মানভঞ্জন যাত্রায় যেমন যাত্রাওয়ালারা কৃষ্ণকে চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে লইয়া যায়, ইনিও তেমনি কৃষ্ণকে গোলোকধামে বিরজার কুঞ্জে লইয়া গিয়াছেন। তাহাতে যাত্রার রাধিকার যেমন ঈর্ষা ও কোপ উপস্থিত হয়, ব্রহ্মবৈবর্তের রাধিকারও সেইরূপ ঈর্ষা ও কোপ উপস্থিত হইয়াছিল। তাহাতে আর একটা মহা গোলযোগ ঘটিয়া যায়। রাধিকা কৃষ্ণকে বিরজার মন্দিরে ধরিবার জন্য রথে চড়িয়া বিরজার মন্দিরে গিয়া উপস্থিত। সেখানে বিরজার দ্বারবান্ ছিলেন শ্রীদামা বা শ্রীদাম। শ্রীদামা রাধিকাকে দ্বার ছাড়িয়া দিল না। এ দিকে রাধিকার ভয়ে বিরজা গলিয়া জল হইয়া নদীরূপ ধারণ করিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাহাতে দুঃখিত হইয়া তাঁহাকে পুনর্জীবন এবং পূর্ব রূপ প্রদান করিলেন। বিরজা গোলোকনাথের সহিত অবিরত আনন্দানুভব করিতে লাগিল। ক্রমশঃ তাহার সাতটি পুত্র জন্মিল। কিন্তু পুত্রগণ আনন্দানুভবের বিঘ্ন,এ জন্য মাতা তাহাদিগকে অভিশপ্ত করিলেন, তাঁহারা অনেক ভর্ৎসনা করিলেন, তাঁহারা সাত সমুদ্র হইয়া রহিলেন। এ দিকে রাধা, কৃষ্ণবিরজা-বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া, কৃষ্ণকে অনেক ভর্ৎসনা করিলেন, এবং অভিশাপ প্রদান করিলেন, যে তুমি গিয়া পৃথিবীতে বাস কর। এ দিকে কৃষ্ণকিঙ্কর শ্রীদামা রাধার এই দুর্ব্যবহারে অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিলেন। শুনিয়া রাধা শ্রীদামাকে তিরস্কার করিয়া শাপ দিলেন, তুমি গিয়া অসূর হইয়া জন্মগ্রহণ কর।শ্রীদামাও রাধাকে শাপ দিলেন, তুমিও গিয়া পৃথিবীতে মানুষী হইয়া পরপত্নী এবং কলঙ্কিনী হইয়া খ্যাত হইবে।

শেষ দুই জনেই কৃষ্ণের নিকট আসিয়া কাঁদিয়া পড়িলেন। শ্রীদামাকে কৃষ্ণ বর দিয়া বলিলেন যে, তুমি অসূরেশ্বর হইবে, যুদ্ধে তোমাকে কেহ পরাভব করিতে পারিবে না। শেষে শঙ্করশূলস্পর্শে মুক্ত হইবে। রাধাকেও আশ্বাসিত করিয়া বলিলেন, ‘তুমি যাও; আমিও যাইতেছি।’ শেষে পৃথিবীর ভারাবতরণ জন্য, তিনি পৃথিবীতে আসিয়া অবতীর্ণ হইলেন।

রাসে সম্ভূয় গোলোকে, সা দধাব হরেঃ পুরঃ।

তেন রাধা সমাখ্যাতা পুরাবিদ্ভির্দ্বিজোত্তম ||-ব্রহ্মখণ্ডে ৫ অধ্যায়ঃ।

কিন্তু আবার স্থানান্তরে,-

রাকারো দানবাচকঃ।

ধা নির্বাণঞ্চ তদ্দাত্রী তেন রাধা প্রকির্তিতা ||-শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে ২৩ অধ্যায়ঃ।

        এ সকল কথা নূতন হইলেও, এবং সর্বশেষে প্রচারিত হইলেও এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বাঙ্গালার বৈষ্ণবধর্মের উপর অতিশয় আধিপত্য স্থাপন করিয়াছে। জয়দেবাদি বাঙ্গালী বৈষ্ণবকবিগণ, বাঙ্গালার জাতীয় সঙ্গীত,বাঙ্গালার যাত্রা মহোৎসবাদির মূল ব্রহ্মবৈবর্তে। কিন্তু আবার স্থানান্তরেব্রহ্মবৈবর্তের মতে তিনি বিধিবিধানানুসারে কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নী। সেই বিবাহবৃত্তান্তটি সবিস্তারে বলিতেছি, বলিবার আগে গীতগোবিন্দের প্রথম কবিতাটা পাঠকের স্মরণ করিয়া দিই।

“মেঘৈর্মেদুরমম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্রুমৈ—

র্নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।

ইত্থং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং

রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃকেলয়ঃ ||

অর্থ। হে রাধে! আকাশ মেঘে স্নিগ্ধ হইয়াছে, তমাল দ্রুম সকলে বনভূমি অন্ধকার হইয়াছে, অতএব তুমিই ইহাকে গৃহে লইয়া যাও, নন্দ এইরূপ আদেশ করায়,পথিস্থ কুঞ্জদ্রুমাভিমুখে চলিত রাধামাধবের যমুনাকূলে বিজনকেলি সকলের জয় হউক।

এ কথার অর্থ কি? টীকাকার কি অনুবাদকার কেহই বিশদ করিয়া বুঝাইতে পারেন না। একজন অনুবাদকার বলিয়াছেন, “গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোকটি কিছু অস্পষ্ট; কবি নায়ক-নায়িকার কোন্ অবস্থা মনে করিয়া লিখিয়াছেন, ঠিক বলা যায় না। টীকাকারের মত, ইহা রাধিকাসখীর উক্তি। তাহাতে ভাব এক প্রকার মধুর হয় বটে, কিন্তু শব্দার্থের কিছু অসঙ্গতি ঘটে।” বস্তুতঃ ইহা রাধিকাসখীর উক্তি নহে; জয়দেব গোস্বামী ব্রহ্মবৈবর্ত-লিখিত এই বিবাহের সূচনা স্মরণ করিয়াই এ শ্লোকটি রচনা করিয়াছেন। এক্ষণে আমি (বঙ্কিমচন্দ্র) ঠিক এই কথাই ব্রহ্মবৈবর্ত হইতে উদ্ধৃত করিতেছি; তবে বক্তব্য এই যে, রাধা শ্রীদামশাপানুসারে শ্রীকৃষ্ণের কয় বৎসর আগে পৃথিবীতে আসিতে বাধ্য হইয়াছিলেন বলিয়া, রাধিকা কৃষ্ণের অপেক্ষা অনেক বড় ছিলেন। তিনি যখন যুবতী, শ্রীকৃষ্ণ তখন শিশু।

“একদা কৃষ্ণসহিতো নন্দো বৃন্দাবনং যযৌ।

তত্রোপবনভাণ্ডীরে চারয়ামাস গোকুলম্ || ১ ||

সরঃসুস্বাদুতোয়ঞ্চ পায়য়ামাস তং পপৌ।

উবাস বটমূলে চ বালং কৃত্বা স্ববক্ষসি || ২ ||

এতস্মিন্নন্তরে কৃষ্ণো মায়াবালকবিগ্রহঃ।

চকার মায়য়াকস্মান্মেঘাচ্ছন্নং নভো মুনে || ৩ ||

মেঘাবৃতং নভো দৃষ্টা শ্যামলং কাননান্তরম্।

ঝঞ্ঝাবাতং মেঘশব্দং বজ্রশব্দঞ্চ দারুণম্ || ৪ ||

বৃষ্টিধারামতিস্থূলাং কম্পমানাংশ্চ পাদপান্।

দৃষ্ট্বৈং পতিতস্কন্ধান্ নন্দো ভয়মবাপ হ || ৫ ||

কথং যাস্যামি গোবৎসং বিহায় স্বাশ্রমং প্রতি।

গৃহং যদি ন যাস্যামি ভবিতা বালকস্য কিম্ || ৬ ||

এবং নন্দে প্রবদতি রুরোদ শ্রীহরিস্তদা।

মায়াভিয়া ভয়েভ্যশ্চ পিতুঃ কণ্ঠং দধার সঃ || ৭ ||

এতস্মিন্নন্তরে রাধা জগাম কৃষ্ণসন্নিধিম্।”

 --- ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম্, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে, ১৫ অধ্যায়ঃ।

  অর্থ। “একদা কৃষ্ণসহিত নন্দ বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন। তথাকার ভাণ্ডীরবনে গোগণকে চরাইতেছিলেন। সরোবরে স্বাদু জল তাহাদিগকে পান করাইলেন,এবং পান করিলেন। এবং বালককে বক্ষে লইয়া বটমূলে বসিলেন। হে মুনে‌! তার পর মায়াতে শিশুশরীরধারণকারী কৃষ্ণ অকস্মাৎ মায়ার দ্বারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করিলেন, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কাননান্তর শ্যামল; ঝঞ্ঝাবাত, মেঘশব্দ, দারুণ বজ্রশব্দ, অতিস্থূল বৃষ্টিধারা, এবং বৃক্ষসকল কম্পমান হইয়া পতিতস্কন্ধ হইতেছে, দেখিয়া নন্দ ভয় পাইলেন। ‘গোবৎস ছাড়িয়া কিরূপেই বা আপনার আশ্রমে যাই, যদি গৃহে না যাই, তবে এই বালকেরই বা কি হইবে,’ নন্দ এইরূপ বলিতেছিলেন, শ্রীহরি তখন কাঁদিতে লাগিলেন; মায়াভয়ে ভীতযুক্ত হইয়া বাপের কণ্ঠ ধারণ করিলেন। এই সময়ে রাধা কৃষ্ণের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।”

রাধার অপূর্ব লাবণ্য দেখিয়া নন্দ বিস্মিত হইলেন, তিনি রাধাকে বলিলেন, “আমি গর্গমুখে জানিয়াছি, তুমি পদ্মারও অধিক হরির প্রিয়া; আর ইনি পরম নির্গুণ অচ্যুত মহাবিষ্ণু; তথাপি আমি মানব, বিষ্ণুমায়ায় মোহিত আছি। হে ভদ্রে!তোমার প্রাণনাথকে গ্রহণ কর; যথায় সুখী হও, যাও। পশ্চাৎ মনোরথ পূর্ণ করিয়া আমার পুত্র আমাকে দিও।”

এই বলিয়া নন্দ রাধাকে কৃষ্ণসমর্পণ করিলেন। রাধাও কৃষ্ণকে কোলে করিয়া লইয়া গেলেন। দূরে গেলে রাধা রাসমণ্ডল স্মরণ করিলেন, তখন মনোহর বিহারভূমি সৃষ্ট হইল। কৃষ্ণ সেইখানে নীত হইলে কিশোরমূর্তি ধারণ করিলেন। তিনি রাধাকে বলিলেন, “যদি গোলোকের কথা স্মরণ হয়, তবে যাহা স্বীকার করিয়াছি, তাহা পূর্ণ করিব।” তাঁহারা এরূপ প্রেমালাপে নিযুক্ত ছিলেন, এমন সময়ে ব্রহ্মা সেইখানে উপস্থিত হইলেন। তিনি রাধাকে অনেক স্তবস্তুতি করিলেন। পরিশেষে নিজে কন্যাকর্তা হইয়া, যথাবিহিত বেদবিধি অনুসারে রাধিকাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিলেন। তাঁহাদিগকে বিবাহবন্ধনে বদ্ধ করিয়া তিনি অন্তর্হিত হইলেন। রায়াণের সঙ্গে রাধিকার যথাশাস্ত্র বিবাহ হইয়াছিল কি না, যদি হইয়া থাকে, তবে পূর্বে কি পরে হইয়াছিল, তাহা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাইলাম না অথচ পুরাণকারের দাবী করে রাধা রায়াণের স্ত্রী। রাধাকৃষ্ণের বিবাহের পর বিহারবর্ণন। বলা বাহুল্য যে, ব্রহ্মবৈবর্তের রাসলীলাও ঐরূপ, যেগুলি সবটাই বানানো।

·      উপরক্ত মন্তব্য তথা “রাধা যখন যুবতী, শ্রীকৃষ্ণ তখন শিশু” ইহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু না। কারণ হিসাব অনুসারে শ্রী কৃষ্ণজন্মাষ্টমী এর ১৫ দিন পর শুক্লপক্ষে রাধাজন্মাষ্টমী আসে। তাহলে এখনে রাধার বয়স < কৃষ্ণর বয়স। কিন্তু পুরাণকার বলছে উল্টোটা। তাই ব্রহ্মবৈবর্তকার পুরাণকার যে মিথ্যা এতে কোনো সন্দেহ নাই।

যাহা হউক, পাঠক দেখিলেন যে, ব্রহ্মবৈবর্তকার সম্পূর্ণ নূতন বৈষ্ণবধর্ম সৃষ্ট করিয়াছেন। সে বৈষ্ণবধর্মের নামগন্ধমাত্র বিষ্ণু বা ভাগবত বা অন্য পুরাণে নাই।রাধাই এই নূতন বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রস্বরূপ। জয়দেব কবি, গীতগোবিন্দ কাব্যে এই নূতন বৈষ্ণবধর্মাবলম্বন করিয়াই গোবিন্দগীতি রচনা করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টান্তানুসরণে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস প্রভৃতি বাঙ্গালার বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণসঙ্গীত রচনা করিয়াছেন। বলিতে গেলে, সকল কবি, সকল ঋষি, সকল পুরাণ, সকল শাস্ত্রের অপেক্ষা ব্রহ্মবৈবর্তকারই বাঙ্গালীর জীবনের উপর অধিকতর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছেন।

·      “শ্রী কৃষ্ণ কীর্ত্তনে” রচনা করে আবার চণ্ডীদাস এই আগুনে ঘি ঢ়েলেছেন। যদিও চণ্ডীদাসের লিখনী তে বহু বহু ভুল ও বানানো মন্তব্য পাওয়া যাই। আর এই মন্তব্যগুলো ভুল ছাড়া আর কিছু না। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন চণ্ডীদাসের লিখা “শ্রী কৃষ্ণ কীর্ত্তনে” ২ টি মন্তব্য।–

·      শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন (চণ্ডীদাস বিরচিত): বৃন্দাবন খণ্ড পৃষ্ঠা-৮৯

“রাধে, তোমার এই নব যৌবনের সুষমা অহরহ আমার মনে জাগিতেছে। তাহাতে আবার তোমার সহিত রমণেচ্ছা প্রবল হইয়া আমার হৃদয়কে অতিমাত্রায় কর্ষণ করিতেছে”

·      মাউলানীর যৌবনে কাহ্নের মন।

বিধুমুখে বোলেঁ কাহ্নাঞিঁ মধুর বচন

সম্বন্ধ না মানে কাহ্নাঞিঁ মোকে বোলেঁ শালী।

লজ্জা দৃষ্টি হরিল ভাগিনা বনমালী  

দেহ বৈরি হৈল মোকে এরুপ যৌবন।

কাহ্ন লজ্জা হরিল দেখিআঁ মোর তন

-   শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের দানখণ্ড : রামগিরীরাগ : পৃষ্ঠা : ২০

(শব্দার্থঃ মাউলানী- মামী, কাহ্নের- কৃষ্ণের)

দেখেছেন এই শ্রী রাধা কে শ্রী কৃষ্ণের মামি বানিয়েছে এই চণ্ডীদাস।

এগুলো কোনোটাতে বিন্দুমাত্র সত্যতা নাই। এগুলো কেবল রসময় লেখকের রসময় সাহিত্য ছাড়া আর কিছু না।

তবে এই শ্রী রাধার প্রকৃত পরিচয় কি ?

এখানে শক্তিবাদের কথা মনে স্মরণ রাখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তকার লিখিয়াছেন যে,কৃষ্ণ রাধাকে বলিতেছেন যে, তুমি না থাকিলে, আমি কৃষ্ণ, এবং তুমি থাকিলে আমি শ্রীকৃষ্ণ। বিষ্ণুপুরাণকথিত এই “শ্রী” লইয়াই তিনি শ্রীকৃষ্ণ। বিষ্ণুপুরাণে যাহা “শ্রী” সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে, ব্রহ্মবৈবর্তে “রাধা” সম্বন্ধে ঠিক তাহাই কথিত হইয়াছে। অর্থ্যাৎ রাধা সেই “শ্রী” এর কাল্পণিক চরিত্র স্বরূপ। রাধা সেই কৃষ্ণের নারী রূপে কল্পিত সেই শক্তি। অর্থ্যাৎ শ্রী রাধা হল সেই শ্রী কৃষ্ণের “শ্রী” অর্থ্যাৎ“শক্তি” যা ছাড়া কৃষ্ণ অপূর্ণ।

এই নিয়ে শ্রী চৈতন্য চরিত্রামৃতে শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বলিয়াছেন –

মহাভাবস্বরূপ শ্রীরাধাঠাকুরাণী ।

সর্বগুণখনি কৃষ্ণকান্তা-শিরোমণি ।।

অর্থাৎ, “মহাভাব-স্বরূপিনী শ্রীমতী রাধারাণী হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত গুণের আধার এবং শ্রীকৃষ্ণের শিরোমণি”

অর্থ্যাৎ শ্রী রাধা হল সেই শ্রী কৃষ্ণের “শ্রী” অর্থ্যাৎ “শক্তি” যা ছাড়া কৃষ্ণ অপূর্ণ। যা প্রমাণিত।

কিন্তু আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ‘রাধাতত্ত্ব’ ছিল কি? বোধ হয় ছিল; কিন্তু এই প্রকার নহে। বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্তে রাধা শব্দের ব্যুৎপত্তি অনেক প্রকার দেওয়া হইয়াছে। তাহার দুইটি পূর্বে ফুটনোটে উদ্ধৃত, আর একটি উদ্ধৃত করিতেছি:—

“রেফো হি কোটিজন্মাঘং কর্মভোগং শুভাশুভম্।

আকারো গর্ভবাসঞ্চ মৃত্যুঞ্চ রোগমুৎসৃজেৎ || ১০৬ ||

ধকার আয়ুষো হানিমাকারো ভববন্ধনম্।

শ্রবণস্মরণোক্তিভ্যঃ প্রণশ্যতি ন সংশয়ঃ || ১০৭ ||

রাকারো নিশ্চলাং ভক্তিং দাস্যং কৃষ্ণপদাম্বুজে।

সর্বেস্পিতং সদানন্দং সর্বসিদ্ধৌঘমীশ্বরম্ || ১০৮ ||

ধকারঃ সহবাসঞ্চ তত্তুল্যকালমেব চ।

দদাতি সার্ষ্টিং সারূপ্যং তত্ত্বজ্ঞানং হরেঃ সমম্ || ১০৯ ||”

                              ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম্, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে, ১৩ অঃ।

ইহার একটিও রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তি নয়। রাধ্ ধাতু আরাধনার্থে, পূজার্থে। যিনি কৃষ্ণের আরাধিকা, তিনিই রাধা বা রাধিকা। বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্তে এ ব্যুৎপত্তি কোথাও নাই। যিনি (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণকার ও কিছু রসময় চরিত্রের বৈষ্ণব)এই রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তি গোপন করিয়া কতকগুলা অবৈয়াকরণিক কল কৌশলের দ্বারা ভ্রান্তি জন্মাইবার চেষ্টা করিয়াছেন, এবং ভ্রান্তির প্রতিপোষণার্থ মিথ্যা করিয়া সামবেদের দোহাই দিয়াছেন,তিনি কখনও ‘রাধা’ শব্দের সৃষ্টিকারক নহেন। যিনি রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তির অনুযায়িক হইয়া রাধারূপক রচনা করেন নাই, তিনি কখনও রাধা শব্দের সৃষ্টিকর্তা নহেন। সেই জন্য বিবেচনা করি যে, আদিম ব্রহ্মবৈবর্তেই রাধার প্রথম সৃষ্টি। এবং সেখানে রাধা কৃষ্ণারাধিকা আদর্শরূপিণী “শ্রী” ছিলেন, সন্দেহ নাই।

রাধা শব্দের আর একটি অর্থ আছে—বিশাখানক্ষত্রের# একটি নাম রাধা। কৃত্তিকা হইতে বিশাখা চতুর্দশ নক্ষত্র। পূর্বে কৃত্তিকা হইতে বৎসর গণনা হইত। কৃত্তিকা হইতে রাশি গণনা করিলে বিশাখা ঠিক মাঝে পড়ে। অতএব রাসমণ্ডলের মধ্যবর্তিনী হউন বা না হউন, রাধা রাশিমণ্ডলের বা রাসমণ্ডলের মধ্যবর্তী বটেন। এই ‘রাসমণ্ডলমধ্যবর্তিনী’ রাধার সঙ্গে ‘রাসমণ্ডলে রাধার কোন সম্বন্ধ আছে কি না, তাহা আসল ব্রহ্মবৈবর্তের অভাবে স্থির করা অসাধ্য।

রাধাশব্দস্য ব্যুৎপত্তিঃ সামবেদ নিরূপিতা || ১৩ অঃ, ১৫৩।

রাধা বিশাখা পুষ্যে তু সিধ্যতিযৌ শ্রবিষ্ঠয়া-অমরকোষ।

তাই, শ্রী রাধা হল সেই শ্রী কৃষ্ণের “শ্রী” অর্থ্যাৎ “শক্তি” যা ছাড়া কৃষ্ণ অপূর্ণ। ঠিক যেমন একজন “সন্তান” একজন “মা” ছাড়া অপূর্ণ। শ্রী রাধা কোনো সম্পর্কের মামি নহে।

সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬

পরা এবং অপরাবিদ্যা

উপনিষদ্ পরা ও অপরা নামক দুইটি বিদ্যা পৃথক্ভাবে উল্লেখ করিয়াছেন; আর ভক্তের নিকটে এই পরাবিদ্যা ও পরাভক্তিতে বাস্তবিক কিছু প্রভেদ নাই। মুণ্ডক উপনিষদে কথিত আছে, ‘ব্রহ্মজ্ঞানীরা বলেন, জানিবার যোগ্য দুই প্রকার বিদ্যা—পরা ও অপরা। উহার মধ্যে অপরা বিদ্যা—ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা অর্থাৎ উচ্চারণ যতি ইত্যাদির বিদ্যা, কল্প অর্থাৎ যজ্ঞপদ্ধতি, ব্যাকরণ, নিরুক্ত অর্থাৎ বৈদিক শব্দসমুহের ব্যুৎপত্তি ও তাহাদের অর্থ যে শাস্ত্রের দ্বারা জানা যায়, এবং ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। আর পরাবিদ্যা তাহাই, যাহা দ্বারা সেই অক্ষরকে জানিতে পারা যায়।’
সুতরাং স্পষ্ট দেখা গেল যে, এই পরাবিদ্যাই ব্রহ্মজ্ঞান। দেবীভাগবতে১৩ পরাভক্তির এই লক্ষণগুলি পাইঃ তৈল যেমন এক পাত্র হইতে পাত্রান্তরে ঢালিবার সময় অবিছিন্ন ধারায় পতিত হয়, তেমনি মন যখন অবিচ্ছিন্নভাবে ভগবানকে স্মরণ করিতে থাকে, তখনই পরাভক্তির উদয় হইয়াছে বুঝিতে হইবে। অবিচ্ছিন্ন অনুরাগের সহিত ভগবানের দিকে হৃদয় ও মনের এরূপ অবিরত ও নিত্য স্থিরতাই মানব-হৃদয়ে সর্বোচ্চ ভগবৎ-প্রেমের প্রকাশ। আর সকল প্রকার ভক্তি কেবল এই পরাভক্তির—‘রাগানুগা’ ভক্তির সোপানমাত্র। যখন সাধকের হৃদয়ে পরানুরাগের উদয় হয়, তখন তাঁহার মন সর্বদাই ভগবানের চিন্তা করিবে, আর কিছুই তাঁহার স্মৃতিপথে উদিত হইবে না। তিনি নিজ মনে তখন ভগবানের চিন্তা ছাড়া অন্য কোন চিন্তাকে স্থান দিবেন না। তাঁহার আত্মা সম্পূর্ণ পবিত্র হইয়া মনোজগতের ও জড়জগতের স্থূল সূক্ষ্ম সর্বপ্রকার বন্ধন অতিক্রম করিয়া শান্ত ও মুক্ত ভাব ধারণ করিবে। এরূপ লোকই কেবল ভগবানকে নিজ হৃদয়ে উপাসনা করিতে সক্ষম| তাঁহার নিকটে অনুষ্ঠান-পদ্ধতি, প্রতীক ও প্রতিমা, শাস্ত্রাদি ও মতামত সবই অনাবশ্যক হইয়া পড়ে—উহাদের দ্বারা তাঁহার আর কোন উপকার হয় না। ভগবানকে এরূপভাবে ভালবাসা বড় সহজ নয়।
সাধারণ মানবীয় ভালবাসা—যেখানে প্রতিদান পায়, সেখানেই বৃদ্ধি পায়; যেখানে প্রতিদান না পায়, সেখানে উদাসীনতা আসিয়া ভালবাসার স্থান অধিকার করে। নিতান্ত অল্প ক্ষেত্রেই কিন্তু কোনরূপ প্রতিদান না পাইলেও প্রেমের বিকাশ দেখা যায়। একটি দৃষ্টান্ত দিবার জন্য আমরা অগ্নির প্রতি পতঙ্গের ভালবাসার সহিত ইহার তুলনা করিতে পারি। পতঙ্গ আগুনকে ভালবাসে, আর উহাতে আত্মসমর্পণ করিয়া প্রাণত্যাগ করে। পতঙ্গের স্বভাবই এইভাবে অগ্নিকে ভালবাসা। জগতে যত প্রকার প্রেম দৃষ্ট হয়, তন্মধ্যে কেবল প্রেমের জন্যই যে প্রেম, তাহাই সর্বোচ্চ ও পূর্ণ নিঃস্বার্থ প্রেম। এইরূপ প্রেম আধ্যাত্মিকতার ভূমিতে কার্য করিতে আরম্ভ করিলেই পরাভক্তিতে লইয়া যায়।
০৬. পরাবিদ্যা ও পরাভক্তি এক
 নভেম্বর

ভাগবতে বিশ্ব সৃষ্টি,,,রহস্য

মহাবিশ্ব সৃষ্টির আদিতে সমস্ত পদার্থ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভি নামক একটি বিন্দুতে ঘনীভূত ছিল,এই পদার্থের নাম ‘প্রধান’।ইহা চিন্ময় পদার্থ বা বিপরীত পদার্থ বা বিজ্ঞানের ভাষায় এন্টিকার্ক দ্বারা তৈরী পদার্থ বলা যাইতে পারে।বিজ্ঞানীরা বলেছেন বিপরীত কণিকা দিয়ে গঠিত পদার্থের বা মহাবিশ্বের আচরণ আমাদের মহাবিশ্বের চাইতে পৃথক হবে।আমি যে‘প্রধান’নামক বিপরীত পদার্থের উল্লেখ করেছি,তা আমাদের বৈজ্ঞানিক কোন নীতিমালা মানবে না,চিন্ময় পদার্থ চিন্ময় জগতের ভিন্ন নীতিমালা মানিয়া চলবে,কিন্তু বিজ্ঞানীরা সেই জগতের নীতিমালা জানে না।‘প্রধান’নামক এই বিপরীত পদার্থ থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে,‘প্রধান’যেহেতু এই জগতের কোন নীতিমালা মেনে চলে না সেজন্য বিজ্ঞানীরা বলছেন সৃষ্টির আদিতে সমস্ত বৈজ্ঞানিক বিধিগুলি ভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল।সৃষ্টির শুরুতে বৈজ্ঞানিক বিধিগুলি ভঙ্গ হওয়ার কারন হইল‘প্রধান’নামক যে চিন্ময় পদার্থ থেকে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে,তা এ জগতের কোন নীতিমালা মেনে চলে না।
‘প্রধান’ চিন্ময় বা বিপরীত পদার্থ।ইহা এই জড় মহাবিশ্বের কোন নীতি মেনে চলে না।সেজন্য ‘প্রধান’-এর আয়তন আমাদের মহাবিশ্বের কোন পদ্ধতির দ্বারা মাপা সম্ভব নয়,‘প্রধান’আমাদের কাছে অপ্রকাশিত বা অব্যক্ত,এর আয়তন আমাদের জগতের নীতিতে শূন্য হবে।এজন্য বিজ্ঞানীরা বলছেন মহাবিশ্বের আয়তন সৃষ্টির শুরুতে শূন্য ছিল।প্রকৃত বিচারে ‘প্রধান’ কোন শূন্য পদার্থ নয় ইহা বিপরীত পদার্থ সেই জন্য ইহাকে সাধারণ পদ্ধতিতে মাপা সম্ভব নয়।
মানুষের শরীরটি জড় পদার্থ অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের পদার্থ,মানুষের মধ্যে যে আত্মা আছে তাকে বলা হয় চিন্ময় পদার্থ অর্থাৎ বিপরীত পদার্থ।এই চিন্ময় আত্মার প্রভাব আমরা অনুভব করিতে পারি কিন্তু যদি আমরা আত্মাকে আমাদের পদ্ধতি দ্বারা মাপতে চাই তবে সেটা সম্ভব নয়।তখন আমরা বলিব আত্মার কোন আয়তন নাই বা আয়তন শূন্য কিন্তু বৈদিক শাস্ত্র চিন্ময় জগতের নীতমালার সাথে পরিচিত,সেজন্য ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে আত্মার আয়তন একটি চুলের অগ্র্রভাগের দশ হাজার ভাগের একভাগ।
আত্মার আয়তন সম্বন্ধে বেদে বলা হয়েছে
বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায় কল্পতে॥(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৫/৯)
অনুবাদ
কেশাগ্রকে শতভাগে ভাগ করিয়া তাহাকে আবার শতভাগে ভাগ করিলে তাহার যে আয়তন হয়,আত্মার আয়তনও ততখানি।
কেশাগ্রশতভাগস্য শতাংশঃসদৃশাত্নকঃ।
জীবঃ সূক্ষস্বরূপপোহয়ং সংখ্যাতীতো হি চিৎকণঃ॥(ভাগবত)
অনুবাদ
অসংখ্য যে চিৎকণা (আত্মা) রহিয়াছে,তাহার আয়তন কেশাগ্রের দশ সহস্র ভাগের এক ভাগের সমান ।একটি কেশাগ্রের দশ সহস্রভাগের একভাগ অর্থাৎ একটি চুলের দশ হাজার ভাগের একভাগ অর্থাৎ আত্মা অত্যন্ত ক্ষুদ্র শক্তি কণিকা যা ভগবানের অংশ।সুতরাং দেখা যাচ্ছে আত্মার আয়তন আছে,কিন্তু সেটা আমাদের এই জগতের কোন পদ্ধতি দ্বারা মাপা সম্ভব নয়।ঠিক সেরকম প্রধানের আয়তন আছে,কিন্তু সেটা বৈজ্ঞানিকেরা এই জগতের পদ্ধতি দ্বারা মাপতে পারে না।সেজন্য তারা বলছে সৃষ্টির শুরুতে মহাবিশ্বের আয়তন শূন্য ছিল।কিন্তু প্রকৃতি বিচারে মহাবিশ্বের আয়তন শূন্য ছিল না।
আমাদের এই শরীরটি জড় পদার্থ যতক্ষন এর মধ্যে আত্মা থাকে, ততক্ষণ ইহা জীবিত থাকে । যখন আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায়, তখন দেহ প্রানহীন জড় পদার্থে পরিণত হয় । আমাদের এই জড় শরীর সৃষ্টির জন্য চিন্ময় আত্মা দায়ী অর্থাৎ চিন্ময় বস্তুর প্রভাবে জড় পদার্থ সৃষ্টি হয় । মানব দেহ বিশ্লেষণ করলে মাটি, জল, আগুন, বাতাস, আকাশ (ইথার) পাওয়া যাবে । কিন্তু এই বস্তুগুলির সমন্বয় ঘটাইয়া মানব শরীর সৃষ্টি সম্ভব নয় কারণ এগুলো সকলেই জড় বা প্রাণহীন ইহাদের জীবন্ত কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা নাই । আম গাছে যতক্ষন আত্মা থাকে ততক্ষন ইহা আম তৈরী করতে পারে কিন্তু যখন আত্মা থাকে না তখন গাছ মৃত জড় পদার্থে পরিণত হয়, সেই কাঠ দ্বারা টেবিল বানানো যেতে পারে কিন্তু টেবিল থেকে আম গাছ বানানো সম্ভব নয় ।
সুতরাং জড় কোন বস্তুর সৃষ্টির পেছনে চিন্ময় আত্মার প্রভাব থাকতে হবে, চিন্ময় বস্তুর প্রভাব ছাড়া কোন কিছু সৃষ্টি সম্ভব নয় । আমাদের এই মহাবিশ্ব জড় বা প্রাণহীন এই জড় পদার্থ সৃষ্টি হয়েছে চিন্ময় বস্তুর প্রভাবে । ভাগবতে সেই পদার্থের নাম ‘প্রধান’ বলে উল্লেখ করেছে । চিন্ময় বস্তু থেকে যখন কোন জড় বস্তু সৃষ্টি হয় তখন একটি মাধ্যম প্রয়োজন হয় যেমন – আম তৈরীর জন্য আত্মার মাধ্যম হহল আমগাছ । মানব শরীর তৈরীর জন্য আত্মার মাধ্যম হল মানুষ, ঠিক সে রকম চিন্ময় বস্তু প্রধান হতে জড় বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির জন্য একটি মাধ্যমের প্রয়োজন, সেই মাধ্যম হল অগ্নিদেব বা আগুন বা তাপমাত্রা মাধ্যম যেহেতু জড় অর্থাৎ এই জগতের বস্তু সেজন্য সেটাকে মাপা সম্ভব । ‘প্রধান’-এর উপর যখন তাপমাত্রা ক্রিয়া করে তখন এর পরিমান ছিল অসীম বা অনন্ত । বিজ্ঞানীরা সেটা বলেছেন সৃষ্টির শুরুতে মহাবিশ্বের আয়তন ছিল শূন্য এবং তাপমাত্রা ছিল অসীম । প্রধানের উপর যখন অসীম তাপমাত্রা ক্রিয়া করে তখন প্রধান ক্ষোভিত বা বিস্ফোরিত হয়ে মহতত্ত্ব নামক জড় পদার্থের সৃষ্টি করে । পরবর্তীতে এই মহতত্ত্ব থেকে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয় ।এই বিস্ফোরণকে বিজ্ঞানীরা হট বিগ ব্যাঙ্গ (Hot Big Bang) বা উত্তপ্ত মহাবিস্ফোরণ বলে । এর নাম বিগব্যাঙ্গ থিওরী (Big Bang Theory) । পরবর্তীতে এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ।
চিন্ময় জগত সম্বন্ধে আলোচনার সারাংশ (A
brief discussion about spiritual
World)
১। আমরা যে জগতে বাস করি তা ছাড়া আরো একটি জগত আছে এর নাম চিন্ময় জগত ।
২। চিন্ময় জগত জড় জগতের ৩ গুণ বড় ।
৩। চিন্ময় জগতকে বিজ্ঞানের ভাষায় বিপরীত জগত বলা যেতে পারে ।
৪। চিন্ময় জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই ।
৫। চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ গ্রহের নাম ‘গোলকবৃন্দাবন’ এখানে ভগবান থাকেন ।
৬। চিন্ময় জগতের কালের কোন প্রভাব নেই, সেজন্য সেখানে কেউ মৃত্যু বরণ করে না ।
৭। আত্মা চিন্ময় জগত থেকে এসেছে ।
৮। চিন্ময় জগতে আলোর জন্য সূর্য বা চন্দ্রের প্রয়োজন নাই ।
৯। চিন্ময় জগত চিন্তামনি বা পরশ পাথর দ্বারা তৈরী ।
১০। চিন্ময় জগত সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের আংশিক ধারণা আছে । বিজ্ঞানীদের ভাষায় এর নাম বিপরীত জগত ।
১১। কার্ক (Quark) হল মৌল কণিকা ইহা দ্বারা মহাবিশ্ব গঠিত ।
১২। কার্ক থেকে বিপরীত কার্ক এবং বিপরীত কার্ক থেকে কার্ক তৈরী হতে পারে ।
১৩। ‘প্রধান’ হল চিন্ময় বা বিপরীত পদার্থ যা থেকে মহাবিশ্ব তৈরী হয়েছে ।
১৪। সৃষ্টির শুরুতে মহাবিশ্বের আয়তন ছিল শূন্য এবং তাপমাত্রা ছিল অসীম ।
১৫। ‘প্রধান’-এর উপর যখন অসীম তাপমাত্রা ক্রিয়া করে তখন ‘প্রধান’ ক্ষোভিত বা বিস্ফোরিত হয় একে বিজ্ঞানীরা বিগব্যাঙ্গ (Big Bang) বা বৃহৎ বিস্ফোরন বলে ।
১৬। জড় জগত চিন্ময় জগতের বিপরীত প্রতিফলন এবং জড় জগত চিন্ময় জগতের নীচে অবস্থিত ।
বৈদিক বিশ্বব্রাহ্মান্ড সৃষ্টি প্রনালী [vedic concept of creation of whole world]
আমরা যে সৌর পরিবারে বসবাস করি এর সাথে আরো কিছু গ্রহ নক্ষত্র যোগ করিলে আমাদের ব্রাহ্মান্ড গঠিত হয় । এ রকম কোটি কোটি ব্রাহ্মান্ড সমন্বয়ে গঠিত হয় বিশ্বব্রাহ্মান্ড ।প্রতিটি ব্রাহ্মান্ডের আয়তন ভিন্ন রকমের । ভাগবতে বর্ননা করা হইয়াছে এই বিশ্বব্রাহ্মান্ড সৃষ্টি হয় চিন্ময় জগত থেকে আর আগে চিন্ময় জগত সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে । চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ গ্রহের নাম গোলক বৃন্দাবন । এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিত্য বা সর্বদা বর্তমান থাকেন অর্থাৎ এটা তার নিজের বাসস্থান বা ধাম । ভগবান কখনো তার নিজের ধাম ত্যাগ করিয়া কোথাও যান না, তবে যখন জড় জগতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তখন তিনি নিজের থেকে ছায়া কৃষ্ণ তৈরী করিয়া জড় জগতে পাঠান । বেদে উল্লেখ করা হইয়াছে ছায়াকৃষ্ণ এবং মূলকৃষ্ণ এক ও অভিন্ন উভয়ের শক্তি সমান।
যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় হয়, তখন কৃষ্ণ গোলক বৃন্দাবন থেকে সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন এবং চিন্ময় জগতের নিচে গোলাকার বলের মত ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি করেন । এই গোলাকার বলকে বলা হয় বিশ্বব্রাহ্মান্ডের গোলক। ইহার মধ্যে অনন্ত কোটি ব্রাহ্মান্ড সৃষ্টি হয় । জড় জগত বা মহাবিশ্ব সষ্টির কারন চিন্ময়জগত।
সায়ম্ভূবতন্ত্রে চতুর্দশাক্ষর মন্ত্রের প্রভাব সম্বন্ধে শিব এবং পার্বতীর আলোচনায় তা প্রতিপন্ন হইয়াছে ।
সেখানে বলা হইয়াছে
চিন্ময়জগতের নিচে জড়জগত অবস্থিত
নানাকল্পলতাকীণং বৈকুন্ঠং ব্যাপকং স্মরেৎ।
অধঃ সাম্যং গুণানাঞ্চ প্রকৃতিঃ সর্বকারণম্।।(চৈতণ্য চরিতামৃত১/৫/১৮)
অনুবাদ
মন্ত্র জপ করিবার সময় সর্বদা চিজ্জগতের কথা স্মরন করা উচিত, যাহা বৈকুন্ঠলোকের অধোভাগে জড় সৃষ্টির কারণস্বরূপা প্রকৃতি অবস্থিত।
এই শ্লোকে বর্ননা করা হইয়াছে চিন্ময়জগত (বৈকুন্ঠে লোকে) এর অধোভাগ বা নিচে জড় জগত অবস্থিত ।
বিশ্ব ব্রাহ্মান্ড সৃষ্টির ধারবাহিক বর্ননা ভগবতে বর্ননা করা হইয়াছে আমি এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করলাম । মহাবিশ্বের জন্য যে গোলক সৃষ্টি হইয়াছে সৃষ্টির অদিতে সেই গোলকের অর্ধেক জল দ্বারা পূর্ণ করা হয়।
ব্রাহ্মান্ডের অর্ধেক জল দ্বারা পূর্ণ করিল
জল ভরি’ অর্ধ তাঁহা কৈল নিজ-বাস।
আর অর্ধে কৈল চৌদ্দভূবন প্রকাশ।।(চৈতণ্য চরিতামৃত১/৫/৯৮)
অনুবাদ
ব্রাহ্মান্ডের অর্ধভাগ জল পূর্ণ করিয়া তিনি সেইখানে তাঁহার নিজের আবাসস্থল তৈরী করিলেন এবং বাকি অর্ধাংশে চতুর্দশভূবন সৃষ্টি করিলেন।
এখানে বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করতে পারেন সৃষ্টির শুরুতে পানি আসিল কিভাবে, ইহা হইতে পারে না, ইহা অবাস্তব কিন্ত ভাগবত ইহার প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছে এই জল সাধারন জড় জগতের জল নয় । ইহা চিন্ময় জগতের অপ্রাকৃত জল এবং ইহা চিন্ময় জগত থেকে কৃষ্ণের নির্দেশে আসিয়াছে।
মহাবিশ্বের গোলকের অর্ধেক যখন চিন্ময় জল দ্বারা পূর্ণ হয় তখন ইহাকে বলা হয় কারন সমূদ্র (casual occan)। এই কারন সমূদ্র বিশ্বব্রাহ্মান্ড সৃষ্টির মূল কারন । এই কারন সমূদ্র চিন্ময় বস্তু, ইহা জড় বস্তু নয় । সেজন্য দেখা যাইতেছে, এই মহাবিশ্বের অর্ধেক জড় বা প্রাণহীন আর অর্ধেক চিন্ময় বা জীবন্ত।সুতরাং দেখা যাইতেছে এই মহাবিশ্বের পদার্থ এবং বিপরীত পদার্থের পরিমান সমান অর্থাৎ শক্তি (positive force) এবং বিপরীত শক্তি (anti force) সমান, সেজন্য উভয়ের যোগফফল শূন্য। এইজন্য বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে শক্তির পরিমান 0(শূন্য)বলিয়া থাকেন।
যখন কারন সমূদ্র জল দ্বারা পূর্ণ হয় তখন গোলক বৃন্দাবনের কৃষ্ণের শরীর হইতে একটি ছায়াকৃষ্ণ বাহির হইয়া কারন সমূদ্রে প্রবেশ করেন।
এই ছায়া কৃষ্ণের নাম মহাবিষ্ণু যিনি কিছুদিন এই চিন্ময় জলে যোগনিদ্রায় (অপ্রাকৃত নিদ্রা)থাকেন।
মহাবিষ্ণু বা হিরন্ময় একহাজার দিব্য বছর জলে থাকে
হিরন্ময় স পুরুষঃ সহস্রপরিবৎসরান্।
অন্ডকোশ উবাসাপ্সু সর্বসত্ত্বোপবৃংহিতঃ।(ভাগবত ৩/৬/৬)।
অনুবাদ
হিরন্ময় নামক বিরাট পুরুষ একহাজার দিব্য বৎসর ব্রহ্মান্ডের জলে বাস করিয়াছিলেন এবং সমস্ত জীবেরাও তাঁহার সঙ্গে শায়িত ছিল ।
এই শ্লোকে বর্ননা করা হইয়াছে, মহাবিষ্ণু শক্তি ১০০০ দিব্য বছর বা ৩৬৫০০০০ বছর কারন সমূদ্রে যোগনিদ্রায়(অপ্রাকৃত নিদ্রা) ছিলেন । তারপর তাঁহার শরীর হইতে কোটি কোটি ব্রাহ্মান্ডের বীজ বুদবুদ আকারে বাহির হয় এই বুদবুদগুলি পরবর্তীতে প্রতেকটি একটি করিয়া পূর্ণাঙ্গ ব্রাহ্মান্ডে পপররিনত হয়।
কারন সমূদ্রে বুদবুদের আকারে ব্রাহ্মান্ড সৃষ্টি
যঃ কারণার্ণবজলে ভজতি স্ম যোগ-নিদ্রামনন্তজগদন্ডসরোমকূপঃ।
আধারশক্তিমবল্যম্ব্য পরাংস্বমূর্তি গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম সংহিতা ৫/৪৭)
এখানে ব্রহ্মাজী বলিয়াছেন, আমি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি, যিনি তাঁহার অংশাবতার মহাবিষ্ণুরূপে যোগনিদ্রায় শায়িত এবং তাঁহার দিব্য শরীরের রোমকূপ থেকে অসংখ্য ব্রাহ্মান্ড বুদবুদ আকারে প্রকাশিত হইতেছে।
এই শ্লোকে বর্ননা করা হইয়াছে, মহাবিষ্ণু কারন সমূদ্রে যোগনিদ্রায় শায়িত
আছেন এবং তাঁহার দিব্য(চিন্ময়) শরীরের রোমকূপ থেকে বুদবুদ আকারে
অসংখ্য ব্রহ্মান্ড প্রকাশিত হইতেছে ।পরবর্তীতে প্রতিটি বুদবুদের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গা থাকে সেখানে একটা করে ব্রহ্মান্ড প্রকাশিত হয় । বুদবুদগুলি কারণ সমুদ্রের মধ্যে হাজার হাজার দিব্য বছর নিমজ্জিত অবস্থায় থাকে ।
ব্রহ্মান্ডগুলি সৃষ্টির পর কারণ সমুদ্রের কারণ বারীতে হাজার হাজার বছর নিমজ্জিত থাকে
বর্ষপূগসহস্রান্তে তদন্ডুমুদকেশয়ম্
কালকর্মস্বভাবস্থো জীবোহজবিমজীবয়ৎ ।। (ভাগবত ২/৫/৩৪)
অনুবাদ
এইভাবে সমস্ত ব্রহ্মান্ডসমূহ হাজার হাজার বছর কারণ সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত ছিল । তারপর সমস্ত জীবের ঈশ্বর তাহাদের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া সেগুলিকে পূর্ণরূপে সজীব করেন ।
এই শ্লোকে বর্ননা করা হইয়াছে ব্রহ্মান্ডগুলি সৃষ্টির পর কারণ সমুদ্রের কারণ বারীতে (জল) হাজার হাজার বছর নিমজ্জিত থাকে । বুদবুদগুলি কারণ সমুদ্রের মধ্যে গুচ্ছ আকারে অবস্থান করে অর্থাৎ একসাথে পুঁথি মালার মত থাকে ।
ব্রহ্মান্ডগুলি পুঁথিমালার মত একসাথে অবস্থান করে
মত্তঃ পরতরং নান্যৎকিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় ।
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সুত্রে মণিগনা ইব ।। (গীতা ৭/৭)
অনুবাদ
হে ধনঞ্চয় (অর্জুন), আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই । সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাঁথা থাকে, তেমনই সমস্ত বিশ্বই আমাতে ওতঃপ্রোতভাবে অবস্থান করে ।
এই শ্লোকে বর্ননা করা হইয়াছে ব্রহ্মান্ডগুলি গুচ্ছ আকারে থাকে ।
প্রতি গুচ্ছে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বুদবুদ থাকে, পরবর্তীতে এই বুদবুদগুলি যখন মহাশূন্যে গুচ্ছ আকারে ভাসমান হয় তখন একে ব্রহ্মান্ডপুঞ্জ বলে । বিজ্ঞানীরা এই ব্রহ্মান্ডপুঞ্জকে ছায়াপথ বা Milky way বলে । বিজ্ঞানীরা প্রমান করেছে আমাদের নীহারিকাতে দৃশ্যমান তাঁরকার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার কোটি । আমি বিজ্ঞান পর্বে আলোচনা করেছি মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য যে সকল তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য তারমধ্যে বুদবুদতত্ত্ব (Bubble Theory) অন্যতম ।
সংক্ষেপে বিজ্ঞানীদের বুদবুদ তত্ত্বের উল্লেখ করছি (A Brife concept about Bubbling theory)
ম্যাসচুসেটস্ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির বৈজ্ঞানিক অ্যালান গুথ (Alan Guth)-এর চেষ্টা ছিল মহাবিশ্বের এমন একটি প্রতিরূপ অন্বেষণ করা, যে প্রতিরূপে বহু প্রাথমিক আকার বিবর্তনের ফলে আধুনিক মহাবিশ্বের মতো একটি জিনিস সৃষ্টি হয়েছে । গুথের এই আলোচনা থেকে বুঝা যায় মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বহু প্রাথমিক আকার থেকে পরবর্তীতে সেই প্রাথমিক আকারগুলি বিবর্তনে মাধ্যমে বর্তমান মহাবিশ্বের সৃষ্টি করেছে । গুথের এই ধারণা বুদবুদ তত্ত্বের জন্ম দিয়াছে । মহাবিশ্বের যে প্রাথমিক অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন ছিল, সেটা ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিটি বুদবুদ বিবর্তনেরর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ব্রহ্মান্ডে পরিণত হয় । সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানী গুথের ধারণা ভাগবতের ধারণার সাথে মিল আছে ।
গুথের বুদবুদ তত্ত্বটি হল ফুটন্ত পানিতে যেমন বুদবুদ উঠতে থাকে, ঠিক সেরকম সময়ের নদীতে অসংখ্য বুদবুদ সৃষ্টি হচ্ছে পরবর্তীতে এই বুদবুদগুলি মহাশূন্যে অসংখ্য বিশ্ব বা ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করছে । গুথের ধারনা বুদবুদগুলি একে অন্যের সাথে মিলিত হতে থাকে এবং সবগুলি বুদবুদ মিলিত হয়ে একটি বুদবুদে রিণত হয় যে বুদবুদের মধ্যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে । গুথ নিজেই তাঁহার তত্ত্বের সমস্যা বর্ণনা করে বলেছেন মহাবিশ্ব এতো দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছিল যে, বুদবুদগুলি যদি আলোকের গতিতে বৃদ্ধি পায় তা হলেও এরা পরস্পর থেকে দূরে অপসারণ করতে থাকবে । সুতরাং বুদবুদ গুলি যুক্ত হতে পারবে না ।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে বিজ্ঞানী হকিং বর্ণনা করেছেন ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি মস্কোতে একটি কণাবাদী মহাকর্ষ (Quantum Gravity) সম্পর্কীয় আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছিলেন । শ্রোতাদের ভিতরে মস্কোর লেবেডভ ইন্সিটিটিউটের একজন তরুণ রুশ ছিলেন, তাহার নাম আন্দ্রে লিন্ডে (Andrei Linde)। তিনি মন্তব্য করেছিলেন বুদবুদগুলি সংযুক্ত না হওয়ার অসুবিধা এড়ানো যায় যদি বুদবুদগুলি এতোবড় হয় যে মহাবিশ্বে আমাদের অঞ্চলটি সম্পূর্ণ একটি বুদবুদের অন্তর্ভূক্ত হয় ।
বিজ্ঞানীদের এই বুদবুদ তত্ত্বের সাথে ভাগবতের বুদবুদের মাধ্যমে সৃষ্টি তত্ত্বের যথেষ্ট মিল রয়েছে । গুথ বলেছেন বুদবুদগুলি সময়ের নদীতে তৈরী হয়েছে, কিন্তু ভাগবতে বর্ণনা রয়েছে বুদবুদগুলি কারণ সমুদ্রের কারণ বারীতে সৃষ্টি হয় । বিজ্ঞানীরা বুদবুদগুলি এক অন্যের সাথে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সমস্যার কথা বলেছেন কিন্তু ভাগবতে সেই সমস্যার সমাধান করে বলেছে বুদবুদগুলি একে অন্যের সাথে মিলিত হয় না । প্রতিটি বুদবুদের মধ্যে একটি করে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়, যার কিছু ধারণা আন্দ্রে লিন্ডে করেছেন। সুতরাং বলা যেতে পারে বিজ্ঞানীরা বুদবুদতত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মান্ড বা মহাবিশ্ব সৃষ্টির যে আংশিক ধারনা ব্যক্ত করেছেন, ভাগবত সেটা অত্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও গঠনমূলকভাবে বর্ণনা করেছে । এখানে উল্লেখ করে রাখা ভাল যে ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে বুদবুদ তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মান্ড বা মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে আর প্রতিটি বুদবুদের মধ্যে যে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়েছে সেটা বিগ ব্যাঙ্গ (Big Bang) বা বৃহৎ বিষ্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে যা আমি পরবর্তীতে আলোচনা করব ।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা বুদবুদ তত্ত্ব এবং বিগ ব্যাঙ্গ তত্ত্ব দুটিকে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি প্রণালী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন । কিন্তু ভাগবতের বর্ণনা মাধ্যমে সামঞ্জস্যতা লাভ করেছে যা পরে আলোচনা করা হবে । বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন সবগুলি বুদবুদ মিলিত হয়ে একটি বড় বুদবুদের মত তৈরী হয়, যার মধ্যে বিশ্বব্রহ্মান্ড বা মহাবিশ্ব অবস্থিত অর্থাৎ মহাবিশ্ব একটি গোলাকার বলের মধ্যে অবস্থিত বা মহাবিশ্বের একটি গোলক রয়েছে । এই বিষয়টি ভাগবতে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে মহাবিশ্ব একটি গোলকের মধ্যে অবস্থিত । মহাবিশ্ব যেহেতু একটি গোলকের মধ্যে অবস্থিত, সেজন্য মহাবিশ্বের স্থানের সীমা রয়েছে আবার ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্তকোটি । অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডের অন্য জায়গার প্রয়োজন অনন্ত……….. তা হলে এই বিষয় দুটি পরস্পর বিরোধী হয়ে যায় । এ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে মহাবিশ্বের গোলক এত বড় যে সেটা মানুষের পক্ষে মাপা বা ধারনা করা সম্ভব নয় । সেজন্য মানুষের কাছে মহাবিশ্বের আয়তন অসীম বলে মনে হবে কিন্তু প্রকৃত বিচারে মহাবিশ্বের একটি গোলাকার বাউন্ডরী রয়েছে ।একে মহাবিশ্বের গোলক বলে, যা বিশ্ব সৃষ্টির সময় তৈরী হয়েছে । এ গোলকের মধ্যে অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ড বুদবুদ আকার অবস্থান করছে । সুতরাং যদি বলা হয় মহাবিশ্বের আয়তন অসীম সেটাও সঠিক আবার মহাবিশ্বের আয়তন অসীম নয় সীমিত সেটাও সঠিক ।
একই সাথে দুটি পরস্পর বিরোধী বিষয় কিভাবে সঠিক হয় সে সম্বন্ধে ভাগবতে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে এর নাম ‘অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব’ । এই তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অচিন্ত্য মানে যা মানুষের কল্পণার বাহিরে অর্থাৎ মানুষ তার সীমিত জ্ঞান দ্বারা বিষয়টি বিবেচনা করতে পারবে না । আর ভেদাভেদ শব্দের অর্থ ভেদ আছে আবার ভেদ নাই অর্থাৎ একই সাথে দুটি পরস্পর বিরোধী ধারনা সঠিক হবে । এর একটি ব্যবহারিক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন- এক বিন্দু জল আর সমুদ্র এই দুটি বিষয় একটি বিচারে উভয়ে সমান, সেটা হল গুণগত দিক অর্থাৎ গুণগত দিক দিয়ে এক বিন্দু জলের মধ্যে যা আছে বিশাল সমুদ্রের মধ্যে তা আছে কিন্তু পরিমাণের দিক দিয়ে দুটি বস্তু এক নয় । কোন কোন বিজ্ঞানী মহাবিশ্বকে অসীম বলে ব্যাখ্যা করেছেন আবার কোন কোন বিজ্ঞানী মহাবিশ্বকে সসীম বা সীমিত বলে ব্যাখ্যা করেছেন, এই উভয় ধারণা ভাগবতের আলোকে সঠিক ।
আন্দ্রে লিন্ডে নামক একজন রুশ বিজ্ঞানী মন্তব্য করেছেন বুদবুদগুলি সংযুক্ত না হওয়ার অসুবিধা এড়ানো যায় যদি বুদবুদ গুলি এতো বড় হয় যে মহাবিশ্বে আমাদের অঞ্চলটি সম্পূর্ণ একটি বুদবুদের অন্তর্ভূক্ত হয় ।
ব্রহ্মান্ডগুলি কিভাবে মহাশূন্যে উথিত হয় (What is the procedure of Universe)
এ যাবৎ আমরা আলোচনা করে দেখলাম ব্রহ্মান্ডগুলি হাজার হাজার বছর ধরে বুদবুদের আকারে কারণ সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত আছে । আমরা জানি, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের গোলকের অর্ধেক চিন্ময় জল দ্বারা পূর্ণ, বাকী উপরের অর্ধেক ফাঁকা মহাশূন্য । মহাবিশ্বের কোন দিক উপর আর কোন দিক নীচে সেটা নির্ণয় করা হয় চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ গ্রহ গোলক বৃন্দাবনের সাথে তুলনা করে, গোলক বৃন্দাবন সবার উপরে অবস্থিত, আমাদের মহাবিশ্ব চিন্ময় জগতের নীচে অবস্থিত । সেজন্য মহাবিশ্বের গোলকের অর্ধেক জল দ্বারা পূর্ণ অংশকে বলা হয় বিশ্বব্রহ্মান্ডের নিম্নভাগ আর উপরের ফাঁকা জায়গায় নাম উপরিভাগ । ব্রহ্মান্ডগুলি হাজার হাজার বছর কারণ সমুদ্রে নিমজ্জিত থাকবার পর মহাবিষ্ণু থেকে একটি শক্তি বাহির হয়ে প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে প্রবেশ করেন এর নাম ‘গর্ভোদকশক্তি’ ।
ব্রহ্মান্ডের গোলক ১০০০ বছর কারণ সমুদ্রে থাকে । সোহশয়িষ্টাব্ধিসলিলে আন্ডকোশো নিরাত্মকঃ সাগ্রং বৈ বর্ষসাহস্রমন্ববাৎসীত্তমীশ্বরঃ (ভাগবত ৩/২০/১৫)
অনুবাদ
সেই হিরন্ময় অন্ডটি অচেতন অবস্থায় এক সহস্র বৎসরেরও অধিক কাল কারণ সমুদ্রের জলে শায়িত ছিল । তারপর ভগবান গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে তাহাতে প্রবেশ করেন । এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডরূপী যে বুদবুদ সেটা অচেতন বা মৃতরূপে ১০০০ (এক হাজার) বছরের বেশি সময় কারণ সমুদ্রের জলে ছিল । তারপর সেটাকে জীবন্ত করবার জন্য ভগবানের একটি শক্তি সেই ব্রহ্মান্ডে প্রবেশ করলেন, এই শক্তির নাম ‘গর্ভোদকশক্তি’ । যখন বুদবুদ রূপ ব্রহ্মান্ডের মধ্যে শক্তি প্রবেশ করল তখন ব্রহ্মান্ডটি কার্যশীল হল ।
গর্ভোদক শক্তি ব্রহ্মান্ডগুলিতে প্রবেশ করবার পর এই শক্তি দুই ভাগে বিভক্ত হয় ।
১। অনন্ত শক্তি
২। পরমাণু শক্তি
ভগবানের শক্তি দুই ভাগে বিভক্ত হল একোহপ্যসৌ রচয়িতং জগদন্ডকোটিং যচ্ছক্তিরস্তি জগদন্ডচয়া যদন্তঃ অন্ডান্ত রস্থপরমাণুচয়ান্তরস্থং গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম সংহিতা ৫/৩৫)
অনুবাদ
আমি পরমেশ্বর ভগবান গোবিন্দের ভজনা করি, যিনি তাঁহার এক অংশের দ্বারা প্রতিটি ব্রহ্মান্ড এবং প্রতিটি পরমাণুতে প্রবিষ্ট হইয়াছেন, এইভাবে তিনি সমগ্র সৃষ্টিতে তাঁহার অনন্ত শক্তির প্রকাশ করিয়াছেন । এই শ্লোকে ভগবানের দুইটি শক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে একটি শক্তি প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে প্রবেশ করেছেন এর নাম অনন্ত শক্তি আর একটি শক্তি প্রতিটি পরমাণুতে প্রবেশ করেছেন এর নাম পরমাণু শক্তি । কারণ সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত ব্রহ্মান্ডগুলি যখন এইভাবে অনন্ত শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন ব্রহ্মান্ডগুলি মহাশূন্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় । কারণ সমুদ্রের জলে অবস্থানরত কোটি কোটি ব্রহ্মান্ডগুলি কার্যশীল হওয়ার পর সমুদ্রে অবস্থিত মহাবিষ্ণু যখন শ্বাস ত্যাগ করেন তখন সমস্ত ব্রহ্মান্ডগুলি অনন্তশক্তির প্রভাবে মহাশূন্যে গমন করতে থাকে ।
ব্রহ্মান্ডগুলি মহাশূন্যে উথিত হওয়া যস্যৈকনিশ্বসিতকালমথাবলম্ব্য জীবন্তি লোমবিলজা জগদন্ডনাথাঃ বিষ্ণূর্মহান্ স ইহ যস্য কলাবিশেষো গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম-সংহিতায় ৫/৪৮)
অনুবাদ
মহাবিষ্ণু বা কারণার্ণবশায়ী বিষ্ণুর একটি নিঃশ্বাসের মাধ্যমে অনন্ত ব্রহ্মান্ড সমূহ প্রকাশিত হয়, আর সেই মহাবিষ্ণু হইতেছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দের একটি অংশ মাত্র ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে অনন্ত ব্রহ্মান্ড সমূহ মহাবিষ্ণুর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে মহাশূণ্যে গমন করছে । মহাশূন্যে ব্রহ্মান্ডপূঞ্জ বা ছায়া পথগুলি যাওয়ার পর মহাবিষ্ণুর শ্বাস ত্যাগের শক্তিতে অপসরণ হওয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমস্ত মহাশূন্যে স্থান দখল করে, এর নাম মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ । একে বিজ্ঞানীরা প্রসারমান মহাবিশ্ব (Expanding Universe) বলে ।
পরবর্তী পোষ্টে আলোচনা করা হবে ভাগবতের আলোকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ । (চলবে………)
লিখেছেন - Shusanta Banda