শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

*আসল কৃষ্ণ*


মূল রচনা - কৃষ্ণচরিত্র -দ্বিতীয় খণ্ড /দশম পরিচ্ছেদ, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 

মূল রচনার ভাবার্থ কে অপরিবর্তিত রেখে, উক্ত পোস্টে আরো নতুন কিছু তথ্য যোগ করে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে মাত্র, যাতে পাঠকরা অল্প সময়ে রচনাটি পড়তে পারে ও শ্রীরাধার সম্পর্কে আরো স্পস্ট ভাবে বিশ্লেষণটিকে বুঝতে পারে।

সম্পাদক- সমীর কুমার মন্ডল 

উপযুক্ত প্রমাণে এটাই প্রমাণিত হয় শ্রী কৃষ্ণের জীবনী তে শ্রী রাধা নামে কোনো নারীর সাথে সম্পর্ক ছিল না। মামির সম্পর্ক তো দূরে থাক, রাধা নামে কোনো গোপী শ্রী কৃষ্ণের সমগ্র জীবনী তে ছিলো না। এই রাধা উৎপত্তি এবং তার সাথে মামির সম্পর্ক ও অবৈধ্য সম্পর্ক সৃষ্টিকার হলেন পূর্বের কিছু “রসময় সাহিত্যিক চরিত্রের বৈষ্ণব মানুষ ও তাদের তৈরী কিছু কাব্য”।

নিচের অংশ গুলি- বঙ্কিমচন্দ্রের “শ্রী কৃষ্ণচরিত্র” গ্রন্থের লেখকের ভাবদৃষ্টি অনুসারে শ্রী রাধা ব্যাখ্য সংগ্রহ করে তুলে ধরা হল.

ভাগবতের এই “রাসপঞ্চাধ্যয়ের” মধ্যে ‘রাধা’ নাম কোথাও পাওয়া যায় না।কিন্তু বৈষ্ণবদের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট। তাঁহারা টীকাটিপ্পনীর ভিতর পুনঃ পুনঃ রাধাপ্রসঙ্গ উত্থাপিত করেছেন, কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নাই। গোপীদিগের অনুরাগাধিক্যজনিত ঈর্ষার প্রমাণ স্বরূপ কবি লিখিয়াছেন যে,তাহারা পদচিহ্ন দেখিয়া অনুমান করিয়াছিল যে, কোন একজন গোপীকে লইয়া কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাও গোপীদিগের ঈর্ষাজনিত ভ্রমমাত্র। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলেন এই কথাই আছে, কাহাকেও লইয়া অন্তর্হিত হইলেন, এমন কথা নাই এবং রাধার নামগন্ধও নাই।

“রাসপঞ্চাধ্যায়ে” কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নাই। ভাগবতে কেন,বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশে বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নাই। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণনাম নাই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নাই বা মূর্তি নাই। বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্যলাভ করিয়াছেন যদিও মহাভারতে, হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে বা ভাগবতে ‘রাধা’ নাই। উপনিষদ সকলের মধ্যে একখানির নাম গোপালতাপনী।কৃষ্ণের গোপমূর্তির উপাসনা ইহার বিষয়। উহার রচনা দেখিয়া বোধ হয় যে,অধিকাংশ উপনিষদ্ অপেক্ষা উহা অনেক আধুনিক ও নবীন। ইহাতে কৃষ্ণ যে গোপগোপীপরিবৃত তাহা বলা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে গোপগোপীর যে অর্থ করা হইয়াছে, তাহা প্রচলিত অর্থ হইতে ভিন্ন। গোপী অর্থে “অবিদ্যা কলা”। টীকাকার বলেন,- “গোপায়ন্তীতি গোপ্যঃ পালনশক্তয়ঃ।” আর গোপীজনবল্লভ অর্থে“গোপীনাং পালনশক্তীনাং জনঃ সমূহঃ তদ্বাচ্যা অবিদ্যাঃ কলাশ্চ তাসাং বল্লভঃ স্বামী প্রেরক ঈশ্বরঃ।” উপনিষদে এইরূপ গোপীর অর্থ আছে। কিন্তু রাসলীলার কোন কথাই এখনে নাই। রাধার নামমাত্র নাই। এক জন প্রধানা গোপীর কথা কাছে, কিন্তু তিনি রাধা নহেন, তাঁহার নাম গান্ধর্বী। তবে এ ‘রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে?

  রাধাকে প্রথমে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেখিতে পাই। উইল্‌সন্ সাহেবর মতে ইহা পুরাণগণের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলিয়াই বোধ হয়। ইহার রচনাপ্রণালী আজিকালিকার ভট্টাচার্যদিগের রচনার মত। ইহাতে ষষ্ঠী মনসারও কথা আছে। আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বিলোপপ্রাপ্ত হইয়াছে। যাহা এখন আছে, তাহাতে এক নূতন দেবতত্ত্ব সংস্থাপিত হইয়াছে। পূর্বাবধিতে প্রসিদ্ধ যে, কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার কিন্তু এখানে পুরানকার বলেন, কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার হওয়া দূরে থাকুক, কৃষ্ণই বিষ্ণুকে সৃষ্টি করিয়াছেন। বিষ্ণু থাকেন বৈকুণ্ঠে, কৃষ্ণ থাকেন গোলোকে রাসমণ্ডলে,—বৈকুণ্ঠ তাহার অনেক নীচে। ইনি কেবল বিষ্ণুকে নহে, ব্রহ্মা, রুদ্র,লক্ষ্মী, দুর্গা প্রভৃতি সমস্ত দেবদেবী এবং জীবগণকে সৃষ্টি করিয়াছেন। ইঁহার বাসস্থান গোলকধামে, বলিয়াছি। তথায় গো, গোপ ও গোপীগণ বাস করে। তাহারা দেবদেবীর উপর। যে গুলি সবটায় মিথ্যা ছাড়া আর কিছু না। সেই গোলোকধামের অধিষ্ঠাত্রী কৃষ্ণবিলাসিনী দেবীই রাধা। রাধার আগে রাসমণ্ডল,রাসমণ্ডলে ইনি রাধাকে সৃষ্টি করেন। রাসের রা, এবং ধাতুর ধা, ইহাতে রাধা নাম নিষ্পন্ন করিয়াছেন। সেই গোপগোপীর বাসস্থান রাধাধিষ্ঠিত গোলোকধাম পূর্বক বিদিগের বর্ণিত বৃন্দাবনের বজনিশ নকল। এখনকার কৃষ্ণযাত্রায় যেমন চন্দ্রাবলী নামে রাধার প্রতিযোগিনী গোপী আছে, গোলকধামেও সেইরূপ বিরজা নাম্নী রাধার প্রতিযোগিনী গোপী ছিল। মানভঞ্জন যাত্রায় যেমন যাত্রাওয়ালারা কৃষ্ণকে চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে লইয়া যায়, ইনিও তেমনি কৃষ্ণকে গোলোকধামে বিরজার কুঞ্জে লইয়া গিয়াছেন। তাহাতে যাত্রার রাধিকার যেমন ঈর্ষা ও কোপ উপস্থিত হয়, ব্রহ্মবৈবর্তের রাধিকারও সেইরূপ ঈর্ষা ও কোপ উপস্থিত হইয়াছিল। তাহাতে আর একটা মহা গোলযোগ ঘটিয়া যায়। রাধিকা কৃষ্ণকে বিরজার মন্দিরে ধরিবার জন্য রথে চড়িয়া বিরজার মন্দিরে গিয়া উপস্থিত। সেখানে বিরজার দ্বারবান্ ছিলেন শ্রীদামা বা শ্রীদাম। শ্রীদামা রাধিকাকে দ্বার ছাড়িয়া দিল না। এ দিকে রাধিকার ভয়ে বিরজা গলিয়া জল হইয়া নদীরূপ ধারণ করিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাহাতে দুঃখিত হইয়া তাঁহাকে পুনর্জীবন এবং পূর্ব রূপ প্রদান করিলেন। বিরজা গোলোকনাথের সহিত অবিরত আনন্দানুভব করিতে লাগিল। ক্রমশঃ তাহার সাতটি পুত্র জন্মিল। কিন্তু পুত্রগণ আনন্দানুভবের বিঘ্ন,এ জন্য মাতা তাহাদিগকে অভিশপ্ত করিলেন, তাঁহারা অনেক ভর্ৎসনা করিলেন, তাঁহারা সাত সমুদ্র হইয়া রহিলেন। এ দিকে রাধা, কৃষ্ণবিরজা-বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া, কৃষ্ণকে অনেক ভর্ৎসনা করিলেন, এবং অভিশাপ প্রদান করিলেন, যে তুমি গিয়া পৃথিবীতে বাস কর। এ দিকে কৃষ্ণকিঙ্কর শ্রীদামা রাধার এই দুর্ব্যবহারে অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিলেন। শুনিয়া রাধা শ্রীদামাকে তিরস্কার করিয়া শাপ দিলেন, তুমি গিয়া অসূর হইয়া জন্মগ্রহণ কর।শ্রীদামাও রাধাকে শাপ দিলেন, তুমিও গিয়া পৃথিবীতে মানুষী হইয়া পরপত্নী এবং কলঙ্কিনী হইয়া খ্যাত হইবে।

শেষ দুই জনেই কৃষ্ণের নিকট আসিয়া কাঁদিয়া পড়িলেন। শ্রীদামাকে কৃষ্ণ বর দিয়া বলিলেন যে, তুমি অসূরেশ্বর হইবে, যুদ্ধে তোমাকে কেহ পরাভব করিতে পারিবে না। শেষে শঙ্করশূলস্পর্শে মুক্ত হইবে। রাধাকেও আশ্বাসিত করিয়া বলিলেন, ‘তুমি যাও; আমিও যাইতেছি।’ শেষে পৃথিবীর ভারাবতরণ জন্য, তিনি পৃথিবীতে আসিয়া অবতীর্ণ হইলেন।

রাসে সম্ভূয় গোলোকে, সা দধাব হরেঃ পুরঃ।

তেন রাধা সমাখ্যাতা পুরাবিদ্ভির্দ্বিজোত্তম ||-ব্রহ্মখণ্ডে ৫ অধ্যায়ঃ।

কিন্তু আবার স্থানান্তরে,-

রাকারো দানবাচকঃ।

ধা নির্বাণঞ্চ তদ্দাত্রী তেন রাধা প্রকির্তিতা ||-শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে ২৩ অধ্যায়ঃ।

        এ সকল কথা নূতন হইলেও, এবং সর্বশেষে প্রচারিত হইলেও এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বাঙ্গালার বৈষ্ণবধর্মের উপর অতিশয় আধিপত্য স্থাপন করিয়াছে। জয়দেবাদি বাঙ্গালী বৈষ্ণবকবিগণ, বাঙ্গালার জাতীয় সঙ্গীত,বাঙ্গালার যাত্রা মহোৎসবাদির মূল ব্রহ্মবৈবর্তে। কিন্তু আবার স্থানান্তরেব্রহ্মবৈবর্তের মতে তিনি বিধিবিধানানুসারে কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নী। সেই বিবাহবৃত্তান্তটি সবিস্তারে বলিতেছি, বলিবার আগে গীতগোবিন্দের প্রথম কবিতাটা পাঠকের স্মরণ করিয়া দিই।

“মেঘৈর্মেদুরমম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্রুমৈ—

র্নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।

ইত্থং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং

রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃকেলয়ঃ ||

অর্থ। হে রাধে! আকাশ মেঘে স্নিগ্ধ হইয়াছে, তমাল দ্রুম সকলে বনভূমি অন্ধকার হইয়াছে, অতএব তুমিই ইহাকে গৃহে লইয়া যাও, নন্দ এইরূপ আদেশ করায়,পথিস্থ কুঞ্জদ্রুমাভিমুখে চলিত রাধামাধবের যমুনাকূলে বিজনকেলি সকলের জয় হউক।

এ কথার অর্থ কি? টীকাকার কি অনুবাদকার কেহই বিশদ করিয়া বুঝাইতে পারেন না। একজন অনুবাদকার বলিয়াছেন, “গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোকটি কিছু অস্পষ্ট; কবি নায়ক-নায়িকার কোন্ অবস্থা মনে করিয়া লিখিয়াছেন, ঠিক বলা যায় না। টীকাকারের মত, ইহা রাধিকাসখীর উক্তি। তাহাতে ভাব এক প্রকার মধুর হয় বটে, কিন্তু শব্দার্থের কিছু অসঙ্গতি ঘটে।” বস্তুতঃ ইহা রাধিকাসখীর উক্তি নহে; জয়দেব গোস্বামী ব্রহ্মবৈবর্ত-লিখিত এই বিবাহের সূচনা স্মরণ করিয়াই এ শ্লোকটি রচনা করিয়াছেন। এক্ষণে আমি (বঙ্কিমচন্দ্র) ঠিক এই কথাই ব্রহ্মবৈবর্ত হইতে উদ্ধৃত করিতেছি; তবে বক্তব্য এই যে, রাধা শ্রীদামশাপানুসারে শ্রীকৃষ্ণের কয় বৎসর আগে পৃথিবীতে আসিতে বাধ্য হইয়াছিলেন বলিয়া, রাধিকা কৃষ্ণের অপেক্ষা অনেক বড় ছিলেন। তিনি যখন যুবতী, শ্রীকৃষ্ণ তখন শিশু।

“একদা কৃষ্ণসহিতো নন্দো বৃন্দাবনং যযৌ।

তত্রোপবনভাণ্ডীরে চারয়ামাস গোকুলম্ || ১ ||

সরঃসুস্বাদুতোয়ঞ্চ পায়য়ামাস তং পপৌ।

উবাস বটমূলে চ বালং কৃত্বা স্ববক্ষসি || ২ ||

এতস্মিন্নন্তরে কৃষ্ণো মায়াবালকবিগ্রহঃ।

চকার মায়য়াকস্মান্মেঘাচ্ছন্নং নভো মুনে || ৩ ||

মেঘাবৃতং নভো দৃষ্টা শ্যামলং কাননান্তরম্।

ঝঞ্ঝাবাতং মেঘশব্দং বজ্রশব্দঞ্চ দারুণম্ || ৪ ||

বৃষ্টিধারামতিস্থূলাং কম্পমানাংশ্চ পাদপান্।

দৃষ্ট্বৈং পতিতস্কন্ধান্ নন্দো ভয়মবাপ হ || ৫ ||

কথং যাস্যামি গোবৎসং বিহায় স্বাশ্রমং প্রতি।

গৃহং যদি ন যাস্যামি ভবিতা বালকস্য কিম্ || ৬ ||

এবং নন্দে প্রবদতি রুরোদ শ্রীহরিস্তদা।

মায়াভিয়া ভয়েভ্যশ্চ পিতুঃ কণ্ঠং দধার সঃ || ৭ ||

এতস্মিন্নন্তরে রাধা জগাম কৃষ্ণসন্নিধিম্।”

 --- ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম্, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে, ১৫ অধ্যায়ঃ।

  অর্থ। “একদা কৃষ্ণসহিত নন্দ বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন। তথাকার ভাণ্ডীরবনে গোগণকে চরাইতেছিলেন। সরোবরে স্বাদু জল তাহাদিগকে পান করাইলেন,এবং পান করিলেন। এবং বালককে বক্ষে লইয়া বটমূলে বসিলেন। হে মুনে‌! তার পর মায়াতে শিশুশরীরধারণকারী কৃষ্ণ অকস্মাৎ মায়ার দ্বারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করিলেন, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কাননান্তর শ্যামল; ঝঞ্ঝাবাত, মেঘশব্দ, দারুণ বজ্রশব্দ, অতিস্থূল বৃষ্টিধারা, এবং বৃক্ষসকল কম্পমান হইয়া পতিতস্কন্ধ হইতেছে, দেখিয়া নন্দ ভয় পাইলেন। ‘গোবৎস ছাড়িয়া কিরূপেই বা আপনার আশ্রমে যাই, যদি গৃহে না যাই, তবে এই বালকেরই বা কি হইবে,’ নন্দ এইরূপ বলিতেছিলেন, শ্রীহরি তখন কাঁদিতে লাগিলেন; মায়াভয়ে ভীতযুক্ত হইয়া বাপের কণ্ঠ ধারণ করিলেন। এই সময়ে রাধা কৃষ্ণের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।”

রাধার অপূর্ব লাবণ্য দেখিয়া নন্দ বিস্মিত হইলেন, তিনি রাধাকে বলিলেন, “আমি গর্গমুখে জানিয়াছি, তুমি পদ্মারও অধিক হরির প্রিয়া; আর ইনি পরম নির্গুণ অচ্যুত মহাবিষ্ণু; তথাপি আমি মানব, বিষ্ণুমায়ায় মোহিত আছি। হে ভদ্রে!তোমার প্রাণনাথকে গ্রহণ কর; যথায় সুখী হও, যাও। পশ্চাৎ মনোরথ পূর্ণ করিয়া আমার পুত্র আমাকে দিও।”

এই বলিয়া নন্দ রাধাকে কৃষ্ণসমর্পণ করিলেন। রাধাও কৃষ্ণকে কোলে করিয়া লইয়া গেলেন। দূরে গেলে রাধা রাসমণ্ডল স্মরণ করিলেন, তখন মনোহর বিহারভূমি সৃষ্ট হইল। কৃষ্ণ সেইখানে নীত হইলে কিশোরমূর্তি ধারণ করিলেন। তিনি রাধাকে বলিলেন, “যদি গোলোকের কথা স্মরণ হয়, তবে যাহা স্বীকার করিয়াছি, তাহা পূর্ণ করিব।” তাঁহারা এরূপ প্রেমালাপে নিযুক্ত ছিলেন, এমন সময়ে ব্রহ্মা সেইখানে উপস্থিত হইলেন। তিনি রাধাকে অনেক স্তবস্তুতি করিলেন। পরিশেষে নিজে কন্যাকর্তা হইয়া, যথাবিহিত বেদবিধি অনুসারে রাধিকাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিলেন। তাঁহাদিগকে বিবাহবন্ধনে বদ্ধ করিয়া তিনি অন্তর্হিত হইলেন। রায়াণের সঙ্গে রাধিকার যথাশাস্ত্র বিবাহ হইয়াছিল কি না, যদি হইয়া থাকে, তবে পূর্বে কি পরে হইয়াছিল, তাহা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাইলাম না অথচ পুরাণকারের দাবী করে রাধা রায়াণের স্ত্রী। রাধাকৃষ্ণের বিবাহের পর বিহারবর্ণন। বলা বাহুল্য যে, ব্রহ্মবৈবর্তের রাসলীলাও ঐরূপ, যেগুলি সবটাই বানানো।

·      উপরক্ত মন্তব্য তথা “রাধা যখন যুবতী, শ্রীকৃষ্ণ তখন শিশু” ইহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু না। কারণ হিসাব অনুসারে শ্রী কৃষ্ণজন্মাষ্টমী এর ১৫ দিন পর শুক্লপক্ষে রাধাজন্মাষ্টমী আসে। তাহলে এখনে রাধার বয়স < কৃষ্ণর বয়স। কিন্তু পুরাণকার বলছে উল্টোটা। তাই ব্রহ্মবৈবর্তকার পুরাণকার যে মিথ্যা এতে কোনো সন্দেহ নাই।

যাহা হউক, পাঠক দেখিলেন যে, ব্রহ্মবৈবর্তকার সম্পূর্ণ নূতন বৈষ্ণবধর্ম সৃষ্ট করিয়াছেন। সে বৈষ্ণবধর্মের নামগন্ধমাত্র বিষ্ণু বা ভাগবত বা অন্য পুরাণে নাই।রাধাই এই নূতন বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রস্বরূপ। জয়দেব কবি, গীতগোবিন্দ কাব্যে এই নূতন বৈষ্ণবধর্মাবলম্বন করিয়াই গোবিন্দগীতি রচনা করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টান্তানুসরণে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস প্রভৃতি বাঙ্গালার বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণসঙ্গীত রচনা করিয়াছেন। বলিতে গেলে, সকল কবি, সকল ঋষি, সকল পুরাণ, সকল শাস্ত্রের অপেক্ষা ব্রহ্মবৈবর্তকারই বাঙ্গালীর জীবনের উপর অধিকতর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছেন।

·      “শ্রী কৃষ্ণ কীর্ত্তনে” রচনা করে আবার চণ্ডীদাস এই আগুনে ঘি ঢ়েলেছেন। যদিও চণ্ডীদাসের লিখনী তে বহু বহু ভুল ও বানানো মন্তব্য পাওয়া যাই। আর এই মন্তব্যগুলো ভুল ছাড়া আর কিছু না। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন চণ্ডীদাসের লিখা “শ্রী কৃষ্ণ কীর্ত্তনে” ২ টি মন্তব্য।–

·      শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন (চণ্ডীদাস বিরচিত): বৃন্দাবন খণ্ড পৃষ্ঠা-৮৯

“রাধে, তোমার এই নব যৌবনের সুষমা অহরহ আমার মনে জাগিতেছে। তাহাতে আবার তোমার সহিত রমণেচ্ছা প্রবল হইয়া আমার হৃদয়কে অতিমাত্রায় কর্ষণ করিতেছে”

·      মাউলানীর যৌবনে কাহ্নের মন।

বিধুমুখে বোলেঁ কাহ্নাঞিঁ মধুর বচন

সম্বন্ধ না মানে কাহ্নাঞিঁ মোকে বোলেঁ শালী।

লজ্জা দৃষ্টি হরিল ভাগিনা বনমালী  

দেহ বৈরি হৈল মোকে এরুপ যৌবন।

কাহ্ন লজ্জা হরিল দেখিআঁ মোর তন

-   শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের দানখণ্ড : রামগিরীরাগ : পৃষ্ঠা : ২০

(শব্দার্থঃ মাউলানী- মামী, কাহ্নের- কৃষ্ণের)

দেখেছেন এই শ্রী রাধা কে শ্রী কৃষ্ণের মামি বানিয়েছে এই চণ্ডীদাস।

এগুলো কোনোটাতে বিন্দুমাত্র সত্যতা নাই। এগুলো কেবল রসময় লেখকের রসময় সাহিত্য ছাড়া আর কিছু না।

তবে এই শ্রী রাধার প্রকৃত পরিচয় কি ?

এখানে শক্তিবাদের কথা মনে স্মরণ রাখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তকার লিখিয়াছেন যে,কৃষ্ণ রাধাকে বলিতেছেন যে, তুমি না থাকিলে, আমি কৃষ্ণ, এবং তুমি থাকিলে আমি শ্রীকৃষ্ণ। বিষ্ণুপুরাণকথিত এই “শ্রী” লইয়াই তিনি শ্রীকৃষ্ণ। বিষ্ণুপুরাণে যাহা “শ্রী” সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে, ব্রহ্মবৈবর্তে “রাধা” সম্বন্ধে ঠিক তাহাই কথিত হইয়াছে। অর্থ্যাৎ রাধা সেই “শ্রী” এর কাল্পণিক চরিত্র স্বরূপ। রাধা সেই কৃষ্ণের নারী রূপে কল্পিত সেই শক্তি। অর্থ্যাৎ শ্রী রাধা হল সেই শ্রী কৃষ্ণের “শ্রী” অর্থ্যাৎ“শক্তি” যা ছাড়া কৃষ্ণ অপূর্ণ।

এই নিয়ে শ্রী চৈতন্য চরিত্রামৃতে শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বলিয়াছেন –

মহাভাবস্বরূপ শ্রীরাধাঠাকুরাণী ।

সর্বগুণখনি কৃষ্ণকান্তা-শিরোমণি ।।

অর্থাৎ, “মহাভাব-স্বরূপিনী শ্রীমতী রাধারাণী হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত গুণের আধার এবং শ্রীকৃষ্ণের শিরোমণি”

অর্থ্যাৎ শ্রী রাধা হল সেই শ্রী কৃষ্ণের “শ্রী” অর্থ্যাৎ “শক্তি” যা ছাড়া কৃষ্ণ অপূর্ণ। যা প্রমাণিত।

কিন্তু আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ‘রাধাতত্ত্ব’ ছিল কি? বোধ হয় ছিল; কিন্তু এই প্রকার নহে। বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্তে রাধা শব্দের ব্যুৎপত্তি অনেক প্রকার দেওয়া হইয়াছে। তাহার দুইটি পূর্বে ফুটনোটে উদ্ধৃত, আর একটি উদ্ধৃত করিতেছি:—

“রেফো হি কোটিজন্মাঘং কর্মভোগং শুভাশুভম্।

আকারো গর্ভবাসঞ্চ মৃত্যুঞ্চ রোগমুৎসৃজেৎ || ১০৬ ||

ধকার আয়ুষো হানিমাকারো ভববন্ধনম্।

শ্রবণস্মরণোক্তিভ্যঃ প্রণশ্যতি ন সংশয়ঃ || ১০৭ ||

রাকারো নিশ্চলাং ভক্তিং দাস্যং কৃষ্ণপদাম্বুজে।

সর্বেস্পিতং সদানন্দং সর্বসিদ্ধৌঘমীশ্বরম্ || ১০৮ ||

ধকারঃ সহবাসঞ্চ তত্তুল্যকালমেব চ।

দদাতি সার্ষ্টিং সারূপ্যং তত্ত্বজ্ঞানং হরেঃ সমম্ || ১০৯ ||”

                              ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম্, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে, ১৩ অঃ।

ইহার একটিও রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তি নয়। রাধ্ ধাতু আরাধনার্থে, পূজার্থে। যিনি কৃষ্ণের আরাধিকা, তিনিই রাধা বা রাধিকা। বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্তে এ ব্যুৎপত্তি কোথাও নাই। যিনি (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণকার ও কিছু রসময় চরিত্রের বৈষ্ণব)এই রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তি গোপন করিয়া কতকগুলা অবৈয়াকরণিক কল কৌশলের দ্বারা ভ্রান্তি জন্মাইবার চেষ্টা করিয়াছেন, এবং ভ্রান্তির প্রতিপোষণার্থ মিথ্যা করিয়া সামবেদের দোহাই দিয়াছেন,তিনি কখনও ‘রাধা’ শব্দের সৃষ্টিকারক নহেন। যিনি রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তির অনুযায়িক হইয়া রাধারূপক রচনা করেন নাই, তিনি কখনও রাধা শব্দের সৃষ্টিকর্তা নহেন। সেই জন্য বিবেচনা করি যে, আদিম ব্রহ্মবৈবর্তেই রাধার প্রথম সৃষ্টি। এবং সেখানে রাধা কৃষ্ণারাধিকা আদর্শরূপিণী “শ্রী” ছিলেন, সন্দেহ নাই।

রাধা শব্দের আর একটি অর্থ আছে—বিশাখানক্ষত্রের# একটি নাম রাধা। কৃত্তিকা হইতে বিশাখা চতুর্দশ নক্ষত্র। পূর্বে কৃত্তিকা হইতে বৎসর গণনা হইত। কৃত্তিকা হইতে রাশি গণনা করিলে বিশাখা ঠিক মাঝে পড়ে। অতএব রাসমণ্ডলের মধ্যবর্তিনী হউন বা না হউন, রাধা রাশিমণ্ডলের বা রাসমণ্ডলের মধ্যবর্তী বটেন। এই ‘রাসমণ্ডলমধ্যবর্তিনী’ রাধার সঙ্গে ‘রাসমণ্ডলে রাধার কোন সম্বন্ধ আছে কি না, তাহা আসল ব্রহ্মবৈবর্তের অভাবে স্থির করা অসাধ্য।

রাধাশব্দস্য ব্যুৎপত্তিঃ সামবেদ নিরূপিতা || ১৩ অঃ, ১৫৩।

রাধা বিশাখা পুষ্যে তু সিধ্যতিযৌ শ্রবিষ্ঠয়া-অমরকোষ।

তাই, শ্রী রাধা হল সেই শ্রী কৃষ্ণের “শ্রী” অর্থ্যাৎ “শক্তি” যা ছাড়া কৃষ্ণ অপূর্ণ। ঠিক যেমন একজন “সন্তান” একজন “মা” ছাড়া অপূর্ণ। শ্রী রাধা কোনো সম্পর্কের মামি নহে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন