রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ভারতীয় দর্শন

হিন্দুধর্ম(সনাতনধর্ম)ভারতীয় উপমহাদেশেরবৃহত্তম তথা একটি দেশীয়ধর্মবিশ্বাস।[১]হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ স্বীয় ধর্মমতকেসনাতন ধর্ম(सनातन धर्म) নামেও অভিহিত করেন।[২][৩]হিন্দুধর্মের সাধারণ "ধরনগুলির" মধ্যেলৌকিকওবৈদিক হিন্দুধর্মথেকেবৈষ্ণবধর্মেরঅনুরূপভক্তিবাদীধারার মতো একাধিক জটিল মতবাদগুলির সমন্বয়ের এক প্রচেষ্টা লক্ষিত হয়।যোগ,কর্মযোগধারণা, ওহিন্দু বিবাহেরমতো বিষয়গুলিও হিন্দুধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।হিন্দুধর্ম একাধিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত। এই ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই।[৪]লৌহযুগীয় ভারতেরঐতিহাসিক বৈদিক ধর্মেএই ধর্মের শিকড় নিবদ্ধ। হিন্দুধর্মকে বিশ্বের "প্রাচীনতম জীবিত ধর্মবিশ্বাস"[৫]বা "প্রাচীনতম জীবিত প্রধান মতবাদ"[৬][৭][৮][৯]আখ্যা দেওয়া হয়।হিন্দুধর্মকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম[note ১]এবং ধর্মাবলম্বীরা একে সনাতন ধর্ম ("চিরন্তন নিয়ম বা চিরন্তন পথ") বলে আখ্যায়িত করেন[১০]। পশ্চিমা পন্ডিতরা হিন্দুধর্মকে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের[১১][note ২]সংমিশ্রণ[note ৩]এবং সংশ্লেষণ[১২][note ৪]হিসেবে গন্য করেন যার মূলে একক কোন ব্যক্তির অবদান নেই[১৩]এবংএর একাধিক উৎপত্তি উৎস রয়েছে[১৪][note ৫]। এটি সনাতনি বা চিরন্তন কর্তব্যের কথা যেমন সততা, অহিংসা, ধৈর্যশীলতা, সমবেদনা ও আত্মনিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি আরো অনেক কথা বলে।[web ১][১৫]হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আছে (কিন্তু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়)পুরুষাত্মা, যা মানব জীবনের সঠিক উদ্দেশ্য। এর মধ্যে আছে ধর্ম (নীতি), অর্থ, কাম এবং মোক্ষ (জন্ম মৃত্যুর পুন পুন অবস্থা থেকে মুক্তি)[১৬][১৭]; কর্ম (কাজ, অভিপ্রায় ও ফল); এবং বিভিন্ন ধরনেরযোগসাধনা (মোক্ষ লাভের পথ)। হিন্দুদের নিত্যকর্মের তালিকায় আছে পূজা, অর্চনা, ধ্যান, পারিবারিকসংস্কার, বার্ষিক অনুষ্ঠান এবং তীর্থযাত্রা। কেউ কেউ সমাজ ও সভ্য জগতে সুখ শান্তি ছেড়ে মোক্ষ লাভের উদ্দেশ্যেসন্ন্যাসগ্রহন করে।[১৮][১৯]জনসংখ্যার বিচারে হিন্দুধর্মখ্রিষ্টধর্মওইসলামেরপরেই বিশ্বেরতৃতীয় বৃহত্তম ধর্মমত। এই ধর্মের অনুগামীদের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। এদের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি হিন্দু বাস করেনভারতীয় প্রজাতন্ত্রে।[২০][২১]এছাড়ানেপাল(২৩,০০০,০০০),মরিশাস(১৪,০০০,০০০) ওইন্দোনেশীয়দ্বীপবালিতে(৩,৩০০,০০০)উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়হিন্দুরা বাস করেন।হিন্দুধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। হিন্দুশাস্ত্রশ্রুতিওস্মৃতিনামে দুই ভাগে বিভক্ত। এই গ্রন্থগুলিতেধর্মতত্ত্ব,দর্শনওপুরাণআলোচিত হয়েছে এবংধর্মানুশীলনসংক্রান্ত নানা তথ্য বিবৃতহয়েছে। এই গ্রন্থগুলির মধ্যেবেদসর্বপ্রাচীন, সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হলউপনিষদ্‌,পুরাণ, ওভারতীয় মহাকাব্যরামায়ণওমহাভারত।ভগবদ্গীতানামে পরিচিত মহাভারতেরকৃষ্ণ-কথিত একটি অংশ বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে থাকে।[২২]ব্যুৎপত্তিমূল নিবন্ধ:হিন্দুস্তানকারাকোরাম রাজপথউত্তর পাকিস্তানেসিন্ধু নদীঅতিক্রম করেছেহিন্দুশব্দটি উৎসারিত হয়েছে সংস্কৃতসিন্ধুশব্দটি থেকে। সিন্ধুভারতীয় উপমহাদেশেরউত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেরএকটি ঐতিহাসিক নদীরনাম।[২৩]ঋগ্বেদেসিন্ধু নদেরস্তুতি করা হয়েছে।[২৪]পরবর্তীকালেরআরবিসাহিত্যেওআল-হিন্দশব্দটির মাধ্যমে সিন্ধুনদ অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে।[২৫]ত্রয়োদশ শতাব্দীতেভারতের নামেরসমার্থক শব্দ হিসেবেহিন্দুস্তানবাহিন্দুস্থানশব্দটির উৎপত্তি হয়। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ"হিন্দুদের দেশ"।[২৬]প্রথমদিকেহিন্দুশব্দটি ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অধিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কেবলমাত্রচৈতন্যচরিতামৃতওচৈতন্য ভাগবতইত্যাদি কয়েকটি ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীরবাংলাগৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মগ্রন্থেযবনবাম্লেচ্ছদেরথেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পৃথক করার জন্য শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে।[২৭]অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় বণিক ও ঔপনিবেশিক শাসকেরাভারতীয়ধর্মবিশ্বাসগুলিরঅনুগামীদের একত্রেহিন্দুনামে অভিহিত করে। ধীরে ধীরে এই শব্দটিআব্রাহামীয় ধর্মসমূহঅথবা অবৈদিক ধর্মবিশ্বাসগুলির (যেমনজৈনধর্ম,বৌদ্ধধর্মওশিখধর্ম) অনুগামী নন এবংসনাতন ধর্মনামক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন সকলভারতীয় বংশোদ্ভুতব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে পড়ে।[২৮][২৯]ইংরেজি ভাষাতে ভারতের স্থানীয় ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি বোঝাতেহিন্দুইজমবাহিন্দুধর্মকথাটি চালু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে।[৩০][পৃষ্ঠার প্রথমে ফেরত্ যান]সংজ্ঞাত্রিবেণী সঙ্গম, অথবাযমুনা নদী,গঙ্গা নদীএবং পৌরাণিকসরস্বতী নদীর মিলনস্থলমঙ্গল মহাদেব, গঙ্গা তলাও এ ১০৮ ফুটেরশিবের মূর্তি,মরিশাসসার্বিক সহিষ্ণুতা থেকে মতবৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও হিন্দুধর্মের রক্ষণশীল উদারতাধ্রুপদী পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় এই ধর্মের সংজ্ঞা নিরুপণের প্রধান বাধাস্বরূপ।[৩১]হিন্দুধর্ম মূলত একটি ব্যবহারিক ধর্মচেতনা। একাধিক প্রথা, সংস্কার ও আদর্শ এতে সন্নিবেশিত। তাই অনেকের মতে এই ধর্মের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ অসুবিধাজনক।[৩২]সেই কারণে ‘রিলিজিয়ন’ বা ধর্ম অপেক্ষা ‘রিলিজিয়াস ট্র্যাডিশন’ বা ধর্মসংস্কার হিসেবেই একে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংজ্ঞায়িত করা হয়।[১]এই বৈশিষ্ট্য হিন্দুধর্মকে বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মবিশ্বাসের পাশাপাশিবিশ্বের সর্বাধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্মের শিরোপাও দান করেছে।[৬][৩৩][৩৪][৩৫]অধিকাংশ ধর্মীয় সংস্কার পবিত্র ধর্মশাস্ত্রবেদহতে সঞ্জাত। যদিও এর ব্যতিক্রমও দুর্লভ নয়। কোনো কোনো সংস্কার অনুসারে মোক্ষ বা পারত্রিক মুক্তিলাভের জন্য কিছু প্রথানুষ্ঠান অপরিহার্য। যদিও এই ব্যাপারেও মতানৈক্য বিদ্যমান। কোনো কোনো হিন্দু দার্শনিক মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের পশ্চাতে এক অস্তিবাদী পরাসত্তারসন্ধান করে ফেরেন, আবার কোনো কোনো হিন্দুনাস্তিকতারচর্চা করে থাকেন। হিন্দুধর্ম কর্মফলের ভিত্তিতে পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস রাখে। মোক্ষ এই ধর্মে জন্ম ও মৃত্যুর চক্রাকার বৃত্ত থেকে মুক্তিরই অপর নাম। যদিও হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রের বাইরেবৌদ্ধওজৈনধর্মওএই মতবাদে বিশ্বাস রাখে।[৩২]এই কারণে হিন্দুধর্মকে মনে করা হয় বিশ্বের জটিলতম ধর্মবিশ্বাসগুলির অন্যতম।[৩৬]এই জটিলতা ব্যতিরেকেও হিন্দুধর্ম যে শুধুমাত্র একটি সংখ্যাগতভাবে সুবৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্মচেতনা তাই নয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রচলিত এই ধর্মবিশ্বাস পৃথিবীর অধুনা বর্তমান ধর্মগুলির মধ্যে প্রাচীনতমও বটে।[৩৭]ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি তথা বিশিষ্ট দার্শনিকসর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনহিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে একে “একটি বিশ্বাসমাত্র” বলতে অস্বীকার করেন। বরং এই ধর্মের যুক্তি ও দর্শনের দিকটি বিচার করে তিনি খোলাখুলিভাবেই এই মত ব্যক্ত করেন যে হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দান করা অসম্ভব। শুধুমাত্র এই ধর্ম অনুশীলনই করা যায়।[৩৮]তেমনই কোনো কোনো পণ্ডিত সুসংজ্ঞায়িত ও রক্ষণশীল ধর্মীয় সংগঠন না বলে হিন্দুধর্মকে “অস্পষ্ট সীমানায়” বর্গায়িত করার পক্ষপাতী। কয়েকটি ধর্মমত হিন্দুধর্মে কেন্দ্রীয়। অন্যগুলি ঠিক কেন্দ্রীয় না হলেও এই পরিসীমার আওতার মধ্যেই পড়ে। এরই ভিত্তিতে ফেরো-লুজি হিন্দুধর্মের সংজ্ঞায়নে একটি “উদাহরণমূলক তাত্ত্বিক অন্বেষণ” (“প্রোটোটাইপ থিওরি অ্যাপ্রোচ”) চালিয়েছেন।[৩৯]উনবিংশ শতকে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদীগণ ‘হিন্দু-ইজম’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু করার পর থেকেই হিন্দুধর্ম একটি বিশ্বধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।[২]এছাড়াও শব্দটির প্রাথমিক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ বা ‘প্রথম যুগের ভারততত্ত্ববিদগণ’, যাঁদের বক্তব্য সাধারণত একপেশে ছিল বলে মনে করা হয়। যদিও হিন্দুধর্মের শিকড় ও তার বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার প্রাচীনত্বের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। সকলেই স্বীকার করেছেন যে প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা থেকেঐতিহাসিক বৈদিক সভ্যতারপ্রাথমিক পর্ব জুড়ে ছিল হিন্দুধর্মের সূচনালগ্ন।[৪০]কেবলমাত্র ধর্মবৈভিন্ন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বৈদিক সংস্কারের ভিত্তিতে হিন্দুধর্মের একটি রূপ দান করেছেন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদগণ – এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু তা সত্য নয়।[৪১][৪২][৪৩]সংজ্ঞা বা ‘হিন্দুইজম’ বা হিন্দুধর্ম শব্দটির দ্বারা কি বোঝায় তা এই কারণেই বলা সম্ভব নয় যে এই ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। হিন্দুধর্মে, বা কারো কারোভাষ্য অনুযায়ী হিন্দুধর্মসমূহে মোক্ষলাভের প্রণালীটি এক এক সম্প্রদায়ের নিকট এক এক প্রকার।বৈদিক ধর্মেরযে রূপগুলিপরিলক্ষিত হয়, তা হিন্দুধর্মের বিকল্প নয় - বরং তার প্রাচীনতম রূপ। তাই পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের লেখায়বৈদিক ধর্ম,ব্রাহ্মণ্যবাদও হিন্দুধর্মের মধ্যে যে প্রভেদ দেখানো হয়ে থাকে তারও বিশেষ যুক্তি নেই।[৯][৪৪]কেউ কেউ মনে করেন, হিন্দুধর্মে কোনো “অনুশাসনের আকারে নিবদ্ধ কোনো একক ধর্মীয় বিশ্বাস” প্রচলিত নেই। এই জন্য ইসলামের বিরাট সংগঠনের পাশে এটিকে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ধর্মব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়। আবার কেউ কেউইহুদি ধর্মেরসঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ একাত্মতার কথাও বলে থাকেন।[৩২]পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্ম কি এবং কিভাবে তা আরও প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত তারই বিচারে হিন্দুধর্মকে যাচাই করা হয়।[৪৫]‘ধর্মবিশ্বাস’ (‘ফেইথ’) শব্দটি ‘ধর্ম’ (‘রিলিজিয়ন’) অর্থে প্রয়োগের ফলে এই বিষয়ে জটিলতা বৃদ্ধি পায়।[৩২]কোনো কোনো পণ্ডিত[৪৬]এবং অনেক হিন্দু দেশীয় ‘সনাতন ধর্ম’-এর সংজ্ঞাটির পক্ষপাতী। এইসংস্কৃতশব্দবন্ধটির অর্থ ‘চিরন্তন ধর্ম (বিধি)’ বা ‘চিরন্তন পন্থা’।[২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন